সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
রাজনীতিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্কার চায় রাজনৈতিক দলগুলো। এসব সংস্কারের মধ্য দিয়েই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে যেতে চায় তারা। সেজন্য সংস্কারের পাশাপাশি একটি নির্বাচনী রোডম্যাপও প্রত্যাশা দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের। বিভিন্ন সভা-সমাবেশসহ দলীয় নানা ফোরামের আলোচনায় তারা এমন মনোভাব ব্যক্ত করে আসছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময়ে দেওয়া বক্তব্যে সে বিষয়টিই তুলে ধরেছেন দলগুলোর নেতারা।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময়কালে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছেন দলগুলোর নেতারা। এসব প্রস্তাবনাকে যার যার অবস্থান থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দলিল হিসেবে অপরিহার্য মনে করছেন তারা। শুধু তাই নয়, সংস্কার প্রস্তাবগুলো একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে বলে মত তাদের। তবে সংস্কার উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কাক্সিক্ষত সেই নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপও চাচ্ছেন দলগুলোর নেতারা।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট দায়িত্বভার গ্রহণ করে শুরুতেই বিএনপি ও জামায়াতসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত ওই মতবিনিময় সভায় প্রয়োজনীয় সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়া হবে বলে জানায় দল বিএনপি ও জামায়াত। তবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায় দল দুটি। বিশেষ করে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনী কোনো রোডম্যাপের সুস্পষ্ট ঘোষণা না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সর্বশেষ শনিবার দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সংলাপে বসেন সরকারপ্রধান। পৃথক এ মতবিনিময় অনুষ্ঠানে প্রায় একই মনোভাব ব্যক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের দিকে যেতে সরকারের প্রতি পরামর্শ দেয় দলগুলো। অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন উপদেষ্টাও উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনার সহযোগী এবং তার সরকারের সময় বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে বলেছে, দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার নির্বাচিত সরকার করতে চায় না। দেশের মানুষ আশা করে অন্তর্বর্তী সরকার কাজগুলো করবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনার দাবিও জানায় দলটি। একই সঙ্গে সংসদ নেতা যেন প্রধানমন্ত্রী না হন এবং দুবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন সেই দাবিও জানিয়েছে তারা। এসব সংস্কার করতে যেটুকু সময় লাগে সেটুকু সময় তারা সরকারকে দিতে চায় বলেও জানিয়েছে।
বর্তমান সংবিধানের আলোকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব দিয়ে বাংলাদেশ জাসদ বলেছে, পুলিশ সংস্কার একটা বড় কাজ। কালো আইন বাতিল করে পুরো বিচার ব্যবস্থারও সংস্কার চেয়েছে তারা। এ ছাড়া দ-িত দুর্নীতিবাজরা যাতে কোনোদিন নির্বাচনে আসতে না পারে এবং রাজনীতিতে কালো টাকা যাতে রিসাইকেল না হয় সেজন্য আইনি সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন দলটির নেতারা।
রাষ্ট্র মেরামতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ৮৩ দফা দাবি জানিয়েছে কর্নেল অলি আহমেদ বীরবিক্রমের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)। পাশাপাশি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়ে দলটি বলেছে, এটা অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও দেশের জন্য ভালো। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে দলটির নেতারা আরও বলেছেন, সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করলে প্রতিটি রাজনৈতিক দল তার নিজ নিজ দল ও সংগঠন নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবে। হঠাৎ করে ঘোষণা করলে হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যস্ত রাখার একমাত্র কৌশল হলো নির্বাচনের একটি ফোরকাস্ট দিয়ে দেওয়া।
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বলেছে, পিআর (সংখ্যানুপাতিক) সিস্টেমে দল ও মার্কা থাকবে। জনগণ ভোট দেবে, যে দল যেভাবে ভোট পাবে সে অনুযায়ী তাদের প্রতিনিধি সংসদে থাকবে, দেশ পরিচালনা করবে। সেখানে সবার স¤পৃক্ততা নিশ্চিত হবে, যার কারণে দেশ সুন্দরভাবে চলবে। এখানে আর বৈষম্যমূলক অবস্থা সৃষ্টি করার মতো কোনো বিষয় থাকবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সর্বত্র ঢেলে সাজানোর পরামর্শও দিয়েছে দলটি। পাশাপাশি খুব শিগগিরই সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
বৈঠকে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশসহ সাতটি দল যার যার পক্ষ থেকে সংস্কারের প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে। নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার, নির্বাচন কমিশনসহ বৈষম্যমূলক দলীয় ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজিয়ে নতুন করে নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য সংস্কার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন দলগুলোর নেতারা। বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ ও প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার যে আয়োজন সেখানে ভারসাম্য আনতে সংস্কার প্রস্তাব দেয় কোনো কোনো দল। পাশাপাশি অযথা কালবিলম্ব না করে যেন নির্বাচনের আয়োজন করা হয় সে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সরকারকে।
সূত্রগুলো বলছে, চরম ভঙ্গুর ও ক্রান্তিলগ্নে দায়িত্ব নেওয়া দেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে রাষ্ট্র মেরামতে পর্যাপ্ত সময় দিতে রাজি রাজনৈতিক দলগুলো। তবে রাষ্ট্র মেরামতের সেই ক্ষণ যেন দীর্ঘকালব্যাপী না হয় সেদিকে কড়া নজর রাখবে তারা। সেজন্য নির্বাচনী রোডম্যাপের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা হবে।