
ড. মতিউর রহমান::
ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রসারের সাথে সাথে যোগাযোগ যেমন দ্রুত ও সহজ হয়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নতুন ধরনের অপরাধের কৌশল। আধুনিক সমাজের এমনই এক উদ্বেগজনক এবং ভয়ংকর ব্যাধি হলো ‘হানি ট্র্যাপ’ বা মধুচক্র। এটি এমন এক সুচতুর প্রতারণার জাল, যেখানে সাধারণত সুন্দরী তরুণীদের ব্যবহার করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী, এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত এই ফাঁদের শিকার হতে পারেন। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে থেকে পরিচালিত এই চক্রগুলো অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমেই অত্যন্ত সক্রিয় থাকে এবং একবার কেউ এই জালে জড়ালে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন চরম সংকটের মুখে পড়ে। হানি ট্র্যাপের মূল ভিত্তি হলো টার্গেট ব্যক্তির ব্যক্তিগত দুর্বলতা, বিশেষ করে যৌন দুর্বলতা বা সম্পর্কের আকাক্সক্ষাকে কাজে লাগানো। প্রতারক চক্রের সদস্যরা, যারা প্রায়শই তরুণী নারী, প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইমো, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে টার্গেট ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়। প্রাথমিকভাবে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেমের সম্পর্কের দিকে এগোতে পারে। এই পর্যায়ে এসে চক্রটি তাদের মূল পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত হয়। এই ফাঁদ পাতার দুটি প্রধান পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি হলো অনলাইনভিত্তিক কৌশল। এখানে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর তরুণীটি টার্গেট ব্যক্তিকে ইন্টারনেট ভিডিও কলে যুক্ত হতে প্রলুব্ধ করে। ভিডিও চলাকালীন তরুণীটি আপত্তিকর বা খোলামেলা আচরণ করে এবং কৌশলে সেই মুহূর্তগুলোর ভিডিও বা ছবি রেকর্ড করে রাখে। একবার আপত্তিকর প্রমাণ হাতে চলে এলেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলের পালা। চক্রটি ভুক্তভোগীর কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে এবং হুমকি দেয় যে টাকা না দিলে ধারণ করা ভিডিও বা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেওয়া হবে। এই হুমকিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে এবং ভুক্তভোগীকে দ্রুত টাকা দিতে বাধ্য করতে, চক্রের সদস্যরা অনেক সময় ভুক্তভোগীর ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট বিশ্লেষণ করে তার স্ত্রী, সন্তান বা ঘনিষ্ঠ স্বজনদের খুঁজে বের করে তাদের সাথেও ডিজিটাল মাধ্যমে যুক্ত হয়। এরপর ভুক্তভোগীকে হুমকি দেওয়া হয় যে দাবি পূরণ না হলে আপত্তিকর বিষয়গুলো সরাসরি তার পরিবারের সদস্যদের কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সামাজিক মর্যাদা, সুনাম এবং পারিবারিক শান্তি হারানোর ভয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই এই ভয়ংকর হুমকিতে ভীত হয়ে পড়েন এবং বাধ্য হয়ে চক্রের দাবি করা অর্থ প্রদান করেন। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো অফলাইন কৌশল, যা সাধারণত আরও বেশি বিপজ্জনক। এখানে সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার পর তরুণীটি টার্গেট ব্যক্তিকে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বাসাবাড়িতে বা নিরাপদ স্থানে ডেকে নিয়ে আসে। সেখানে চক্রের অন্য সদস্যরা উপস্থিত থাকতে পারে। ভুক্তভোগী সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে জিম্মি করা হয় এবং মুক্তিপণের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। এই পদ্ধতিতে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং শারীরিক ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা অনলাইন পদ্ধতির চেয়েও মারাত্মক। উভয় পদ্ধতিতেই চক্রগুলো একটানা বা কিস্তিতে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কখনো কখনো ‘কলগার্ল’ সরবরাহের আড়ালেও হানি ট্র্যাপের কৌশল ব্যবহার করা হয় বলে জানা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষরা এই ফাঁদে বেশি পা দেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ নানান পেশাজীবী এবং সমাজের উঁচু স্তরের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা রয়েছেন। এমনকি দেশে কর্মরত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও এই চক্রগুলো টার্গেট করার চেষ্টা করে বা করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক মাধ্যমে ছদ্মবেশ ধারণের সুযোগ এই চক্রগুলোকে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। হানি ট্র্যাপের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা কেবল যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন তা নয়, এর চেয়েও ভয়াবহ ক্ষতি হয় তাদের সামাজিক মর্যাদা, সুনাম এবং ব্যক্তিগত জীবনে। একবার এই ফাঁদে জড়ালে ভুক্তভোগীর মানসিক শান্তি মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়। সবসময় এক ধরনের চাপা আতংক, লাজুকতা এবং অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, যা তার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে। পারিবারিক জীবনে নেমে আসে অবিশ্বাস ও অশান্তি, এমনকি পরিবার ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। এই সামাজিক লাজলজ্জার ভয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই প্রতারণার বিষয়টি গোপন রাখেন এবং আইনি সহায়তা নিতে দ্বিধা করেন। তারা মনে করেন, আইনি পদক্ষেপ নিলে বা অভিযোগ জানালে বিষয়টি জনসমক্ষে আসবে এবং তাদের সম্মানহানি ঘটবে। ভুক্তভোগীদের এই নীরবতাই প্রকৃতপক্ষে প্রতারক চক্রগুলোর সবচেয়ে বড় শক্তি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার পুলিশ সেন্টারগুলোতে প্রতি মাসে এই ধরনের ৩০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়লেও, এটি প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য। বাস্তবে এই ফাঁদের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা অভিযোগ জানান, তাদের মধ্যেও প্রায় ৯০ শতাংশ ভুক্তভোগী পরে মামলা করতে রাজি হন না, কারণ তারা চান না যে তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের পরিচয় বা ঘটনার বিস্তারিত জনসমক্ষে চলে আসুক। ভুক্তভোগীদের এই আইনি পদক্ষেপ থেকে দূরে থাকা বা নীরব থাকার প্রবণতা অপরাধীদের পার পেয়ে যেতে সাহায্য করে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসে এবং পুনরায় একই অপরাধে যুক্ত হয়। এই চক্রগুলো প্রায়শই আন্তর্জাতিকভাবেও সংযুক্ত থাকে। হাতিয়ে নেওয়া অর্থ তারা হুন্ডি বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের বাইরে, বিশেষ করে যেখানে ফাঁদ পাতা তরুণীটি অবস্থান করে, সেখানে পাচার করে দেয়। অর্থ লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টগুলো অনেক সময় ভুয়া ঠিকানা বা পরিচয়ে খোলা হয়, যা অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় আনা আরও কঠিন করে তোলে। এমনকি সমাজে প্রভাবশালী কিছু আইনজীবীও এ ধরনের ফাঁদে পড়ে জিম্মি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলার সুযোগ তৈরি করছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাইবার জগতে প্রবেশ করা বেশিরভাগ মানুষেরই সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং তারা অনলাইন ঝুঁকির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার বাড়লেও, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেকেরই ধারণা কম। এই অসচেতনতাকেই হানি র্ট্যাপের মতো অপরাধী চক্রগুলো তাদের ফাঁদ সফল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন যে, কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একক প্রচেষ্টায় এ ধরনের অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। এটি মোকাবিলার জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা অপরিহার্য। অনেক ভুক্তভোগীই প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি অবগত নন, এ সুযোগটি প্রতারকরা গ্রহণ করে। হানি ট্র্যাপের মতো ভয়ংকর ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত সতর্কতা অবলম্বন করার কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক মাধ্যম বা যে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারও সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারও প্রলোভনে বা লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে ব্যক্তিগত সংবেদনশীল তথ্য, ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে, ভিডিওকলে যুক্ত হওয়ার সময় বা আপত্তিকর কোনো আলাপে জড়ানোর আগে চরম সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনলাইন জগতে মানুষের আসল পরিচয় বা উদ্দেশ্য বোঝা অনেক কঠিন হতে পারে। এই ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ভুক্তভোগীদের মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে লাজলজ্জা ভেঙে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত, তবে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এ চক্রগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে এবং আরও বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একই সাথে সাইবার নিরাপত্তা এবং অনলাইনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য, তবে এর ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকাটা প্রত্যেকের জন্য সময়ের দাবি। প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ সচেতনতাই কেবল হানি ট্র্যাপের মতো ভয়ংকর ফাঁদ থেকে ব্যক্তি এবং সমাজকে রক্ষা করতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, হানি ট্র্যাপ আধুনিক সমাজের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি, যা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের ব্যক্তিগত দুর্বলতা এবং সামাজিক ভয় পুঁজি করে বিকশিত হয়েছে। এই প্রতারণার জাল সমাজের প্রায় সব স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভয়ংকর চক্র ভেঙে দিতে হলে ব্যক্তিগত সতর্কতা, ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ - এই তিনটির সমন্বিত প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন। তবেই আমরা আমাদের ডিজিটাল জগৎ আরও নিরাপদ করে তুলতে পারবো এবং এই ভয়ংকর ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারবো। লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রসারের সাথে সাথে যোগাযোগ যেমন দ্রুত ও সহজ হয়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নতুন ধরনের অপরাধের কৌশল। আধুনিক সমাজের এমনই এক উদ্বেগজনক এবং ভয়ংকর ব্যাধি হলো ‘হানি ট্র্যাপ’ বা মধুচক্র। এটি এমন এক সুচতুর প্রতারণার জাল, যেখানে সাধারণত সুন্দরী তরুণীদের ব্যবহার করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী, এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত এই ফাঁদের শিকার হতে পারেন। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে থেকে পরিচালিত এই চক্রগুলো অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমেই অত্যন্ত সক্রিয় থাকে এবং একবার কেউ এই জালে জড়ালে তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন চরম সংকটের মুখে পড়ে। হানি ট্র্যাপের মূল ভিত্তি হলো টার্গেট ব্যক্তির ব্যক্তিগত দুর্বলতা, বিশেষ করে যৌন দুর্বলতা বা সম্পর্কের আকাক্সক্ষাকে কাজে লাগানো। প্রতারক চক্রের সদস্যরা, যারা প্রায়শই তরুণী নারী, প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইমো, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে টার্গেট ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়। প্রাথমিকভাবে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেমের সম্পর্কের দিকে এগোতে পারে। এই পর্যায়ে এসে চক্রটি তাদের মূল পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য প্রস্তুত হয়। এই ফাঁদ পাতার দুটি প্রধান পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমটি হলো অনলাইনভিত্তিক কৌশল। এখানে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর তরুণীটি টার্গেট ব্যক্তিকে ইন্টারনেট ভিডিও কলে যুক্ত হতে প্রলুব্ধ করে। ভিডিও চলাকালীন তরুণীটি আপত্তিকর বা খোলামেলা আচরণ করে এবং কৌশলে সেই মুহূর্তগুলোর ভিডিও বা ছবি রেকর্ড করে রাখে। একবার আপত্তিকর প্রমাণ হাতে চলে এলেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলের পালা। চক্রটি ভুক্তভোগীর কাছে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে এবং হুমকি দেয় যে টাকা না দিলে ধারণ করা ভিডিও বা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেওয়া হবে। এই হুমকিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে এবং ভুক্তভোগীকে দ্রুত টাকা দিতে বাধ্য করতে, চক্রের সদস্যরা অনেক সময় ভুক্তভোগীর ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট বিশ্লেষণ করে তার স্ত্রী, সন্তান বা ঘনিষ্ঠ স্বজনদের খুঁজে বের করে তাদের সাথেও ডিজিটাল মাধ্যমে যুক্ত হয়। এরপর ভুক্তভোগীকে হুমকি দেওয়া হয় যে দাবি পূরণ না হলে আপত্তিকর বিষয়গুলো সরাসরি তার পরিবারের সদস্যদের কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সামাজিক মর্যাদা, সুনাম এবং পারিবারিক শান্তি হারানোর ভয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই এই ভয়ংকর হুমকিতে ভীত হয়ে পড়েন এবং বাধ্য হয়ে চক্রের দাবি করা অর্থ প্রদান করেন। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হলো অফলাইন কৌশল, যা সাধারণত আরও বেশি বিপজ্জনক। এখানে সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার পর তরুণীটি টার্গেট ব্যক্তিকে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বাসাবাড়িতে বা নিরাপদ স্থানে ডেকে নিয়ে আসে। সেখানে চক্রের অন্য সদস্যরা উপস্থিত থাকতে পারে। ভুক্তভোগী সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে জিম্মি করা হয় এবং মুক্তিপণের জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। এই পদ্ধতিতে ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং শারীরিক ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা অনলাইন পদ্ধতির চেয়েও মারাত্মক। উভয় পদ্ধতিতেই চক্রগুলো একটানা বা কিস্তিতে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়। কখনো কখনো ‘কলগার্ল’ সরবরাহের আড়ালেও হানি ট্র্যাপের কৌশল ব্যবহার করা হয় বলে জানা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী পুরুষরা এই ফাঁদে বেশি পা দেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ নানান পেশাজীবী এবং সমাজের উঁচু স্তরের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা রয়েছেন। এমনকি দেশে কর্মরত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদেরও এই চক্রগুলো টার্গেট করার চেষ্টা করে বা করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং সামাজিক মাধ্যমে ছদ্মবেশ ধারণের সুযোগ এই চক্রগুলোকে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যেতে সাহায্য করে। হানি ট্র্যাপের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা কেবল যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন তা নয়, এর চেয়েও ভয়াবহ ক্ষতি হয় তাদের সামাজিক মর্যাদা, সুনাম এবং ব্যক্তিগত জীবনে। একবার এই ফাঁদে জড়ালে ভুক্তভোগীর মানসিক শান্তি মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়। সবসময় এক ধরনের চাপা আতংক, লাজুকতা এবং অপরাধবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, যা তার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে। পারিবারিক জীবনে নেমে আসে অবিশ্বাস ও অশান্তি, এমনকি পরিবার ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। এই সামাজিক লাজলজ্জার ভয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই প্রতারণার বিষয়টি গোপন রাখেন এবং আইনি সহায়তা নিতে দ্বিধা করেন। তারা মনে করেন, আইনি পদক্ষেপ নিলে বা অভিযোগ জানালে বিষয়টি জনসমক্ষে আসবে এবং তাদের সম্মানহানি ঘটবে। ভুক্তভোগীদের এই নীরবতাই প্রকৃতপক্ষে প্রতারক চক্রগুলোর সবচেয়ে বড় শক্তি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার পুলিশ সেন্টারগুলোতে প্রতি মাসে এই ধরনের ৩০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়লেও, এটি প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় খুবই সামান্য। বাস্তবে এই ফাঁদের শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা অভিযোগ জানান, তাদের মধ্যেও প্রায় ৯০ শতাংশ ভুক্তভোগী পরে মামলা করতে রাজি হন না, কারণ তারা চান না যে তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের পরিচয় বা ঘটনার বিস্তারিত জনসমক্ষে চলে আসুক। ভুক্তভোগীদের এই আইনি পদক্ষেপ থেকে দূরে থাকা বা নীরব থাকার প্রবণতা অপরাধীদের পার পেয়ে যেতে সাহায্য করে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসে এবং পুনরায় একই অপরাধে যুক্ত হয়। এই চক্রগুলো প্রায়শই আন্তর্জাতিকভাবেও সংযুক্ত থাকে। হাতিয়ে নেওয়া অর্থ তারা হুন্ডি বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের বাইরে, বিশেষ করে যেখানে ফাঁদ পাতা তরুণীটি অবস্থান করে, সেখানে পাচার করে দেয়। অর্থ লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টগুলো অনেক সময় ভুয়া ঠিকানা বা পরিচয়ে খোলা হয়, যা অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় আনা আরও কঠিন করে তোলে। এমনকি সমাজে প্রভাবশালী কিছু আইনজীবীও এ ধরনের ফাঁদে পড়ে জিম্মি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে এবং আইনি প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলার সুযোগ তৈরি করছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাইবার জগতে প্রবেশ করা বেশিরভাগ মানুষেরই সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং তারা অনলাইন ঝুঁকির ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন নন। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহার বাড়লেও, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে অনেকেরই ধারণা কম। এই অসচেতনতাকেই হানি র্ট্যাপের মতো অপরাধী চক্রগুলো তাদের ফাঁদ সফল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন যে, কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একক প্রচেষ্টায় এ ধরনের অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। এটি মোকাবিলার জন্য সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা অপরিহার্য। অনেক ভুক্তভোগীই প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব বেশি অবগত নন, এ সুযোগটি প্রতারকরা গ্রহণ করে। হানি ট্র্যাপের মতো ভয়ংকর ফাঁদ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত সতর্কতা অবলম্বন করার কোনো বিকল্প নেই। সামাজিক মাধ্যম বা যে কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারও সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারও প্রলোভনে বা লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে ব্যক্তিগত সংবেদনশীল তথ্য, ছবি বা ভিডিও শেয়ার করা থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে, ভিডিওকলে যুক্ত হওয়ার সময় বা আপত্তিকর কোনো আলাপে জড়ানোর আগে চরম সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনলাইন জগতে মানুষের আসল পরিচয় বা উদ্দেশ্য বোঝা অনেক কঠিন হতে পারে। এই ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ভুক্তভোগীদের মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে লাজলজ্জা ভেঙে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত, তবে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে এ চক্রগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে এবং আরও বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একই সাথে সাইবার নিরাপত্তা এবং অনলাইনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। স্কুল-কলেজ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং সাইবার নিরাপত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া উচিত। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য, তবে এর ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকাটা প্রত্যেকের জন্য সময়ের দাবি। প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ সচেতনতাই কেবল হানি ট্র্যাপের মতো ভয়ংকর ফাঁদ থেকে ব্যক্তি এবং সমাজকে রক্ষা করতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, হানি ট্র্যাপ আধুনিক সমাজের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি, যা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের ব্যক্তিগত দুর্বলতা এবং সামাজিক ভয় পুঁজি করে বিকশিত হয়েছে। এই প্রতারণার জাল সমাজের প্রায় সব স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। এই ভয়ংকর চক্র ভেঙে দিতে হলে ব্যক্তিগত সতর্কতা, ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ - এই তিনটির সমন্বিত প্রচেষ্টা একান্ত প্রয়োজন। তবেই আমরা আমাদের ডিজিটাল জগৎ আরও নিরাপদ করে তুলতে পারবো এবং এই ভয়ংকর ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকতে পারবো। লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।