
একটি পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, “সুনামগঞ্জে ধাঙর, পাদুকাশিল্পী, চর্মকার, ক্ষৌরকার, জেলে প্রভৃতি পরিচয়ের বহু দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন রয়েছেন। তাঁদের জীবনমানের তেমন উন্নয়ন না হওয়ার বিষয়টি সকলে অবগত। সমাজে কার্যকর অর্থে তাঁদের কোনো কণ্ঠও নেই। এঁরা অবজ্ঞা ও অবহেলা নিয়েই অপমানের জীবন যাপন করছেন। এই জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিগণের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, আপনারা নিজেরা শ্রেণিসচেতন হোন, সম্প্রদায়ভুক্ত সকলকে এই সচেতনতা দান করুন এবং শ্রেণিবৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে একযোগে কাজ করুন।”
সমাজে দলিত শ্রেণির প্রতি এবংবিধ আহ্বান রাখার জন্য সম্পাদকীয় কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। কারণ এই আহ্বানের ভেতরে বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু দলিত সম্প্রদায়ের সকলের শ্রেণিসচেতনতা অর্জন করাটা কোনও না কোনওভাবে সম্ভব হলেও ‘শ্রেণিবৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠন’-এর কাজে একজোট হয়ে তারা কী করে নিয়োজিত হবেন সে বিষয়টা বোধগম্যতার সীমায় এসে ধরা দিচ্ছে না, কারণ আপাতত রাষ্ট্র নিয়ে দলিত মানুষজনের পক্ষে কাজ করার কোনও অবকাশ নেই, রাষ্ট্রের ভেতরে তাদেরকে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে, যেমন রাখা হয়েছে সিংহভাগ বেসরকারি মানুষকে। ‘ভদ্রলোক দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রিক-সামাজিক কাঠামো’র ভেতরে তারা কেবল শাসিত ও শোষিত হয়ে ‘দলিত’ই হতে পারেন, এর বেশি কীছু নয়। সম্পাদকীয়তে উল্লেখিত তাদের দাবি, “বৈষম্যকে [আসলে সমাজে বৈষম্য জারি রাখার অপকর্মকে] শাস্তিযাগ্য অপরাধ হিসাবে চিহ্নিতকরণ, বৈষম্যবিলোপ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, হরিজন-দলিত জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা দেয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও সরকারি চাকুরিতে বিশেষ কোটা চালু করা, বংশ পরম্পরায় বসবাসের জায়গাকে তাঁদের নামে দলিল করে দেয়া ইত্যাদি”র মধ্যে ‘বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা’র মতো মৌলিক অধিকার থেকে ‘ভদ্রলোকেরা’ বাদে দেশের সকল মানুষই বঞ্চিত। ‘ভদ্রলোক’ সম্পদশালীরা এই দু’টি অধিকার কিনতে পারলেও ‘দলিত’ সাধারণ গরিব কৃষক মেহনতি মানুষেরা সহজে কিনতে পারেন না, বঞ্চিতই থেকে যান। এদিক থেকে দেশের বেশিরভাগ মানুষেরাই ‘ধাঙর সদৃশ দলিতজন’দের কাতারেই দা-ায়মান।
দলিতজনদের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার অবকাশ না থাকার কারণ হলো তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নন, রাষ্ট্রক্ষমতার লাগাম আছে সম্পাদকীয়তে কথিত ‘তথাকথিত ভদ্রলোক’দের হাতে। তাদেরকে প্রথম বন্ধনীতে ‘মূলত লুটেরা, পরশ্রমজীবী, অনুৎপাদনশীল গোষ্ঠী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দলিতরা শ্রেণিসচেতন হয়ে উঠুন সে-অভিমতের সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করছি এবং সেই সঙ্গে দলিত অন্যান্য সকল বেসরকারি মানুষজনেরাও শ্রেণিসচেতন হয়ে উঠুন এই কামনা করছি। কারণ শ্রেণিসচেতনতা অর্জন ছাড়া সমাজ বদলের কাজ চালানো সম্ভব নয়। ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘শ্রেণিবৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠন’-এর কাজটি করতে গেলে আগে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে। তারও আগে সকল দলিতজনদেরকে (শাসিত ও শোষিতদেরকে) রাজনীতিটা করতে হবে ভদ্রলোকদের (লুটেরাগোষ্ঠী) বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। যেহেতু ভদ্রলোকেরা রাজনীতি করছেন দলিতদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে। তাই ‘রাষ্ট্র গঠন’-এর আগে রাজনীতিটা শিখতে হবে।