
সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
অধরা সংস্কৃতির তালিকায় থাকা কোনো ঐতিহ্যের নাম পরিবর্তনে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকলেও বাংলাদেশ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো।
বাংলা নববর্ষ বরণে পয়লা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে যে শোভাযাত্রা হয়, সেটির নাম এ বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ থেকে পাল্টে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ করা হয়েছে। শোভাযাত্রা উদ্যাপন কমিটির প্রধান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার নাম পরিবর্তনের জন্য ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কি না, সেটা তার জানা নেই।
উদ্যাপন কমিটির প্রধান বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে; কারণ, এটার মূল যে স্পিরিট (চেতনা), আমাদের সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য, ইউনেস্কোর যে মূল চেতনাটা - কোথাও নামের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয় না। ওখানকার (ইউনেস্কো) ইনস্ক্রিপশনে যা বলা আছে, তাতে নাম পরিবর্তনে কোথাও কোনো বাধা নেই।
তবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো জানিয়েছে, এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে, তা মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুসরণ করা হয়নি।
ইউনেস্কোর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গতিশীল এবং জীবন্ত প্রকৃতি স্বীকার করে এমন পরিবর্তনের জন্য একটি স্পষ্ট পদ্ধতি রাখা হয়েছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়, এই প্রক্রিয়ায় ২৪টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত কনভেনশনের গভর্নিং বডির কালচারাল হেরিটেজ কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন।
তবে এখন পর্যন্ত (১৬ এপ্রিল, ২০২৫), ইউনেস্কোর কাছে নাম পরিবর্তনের কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জমা দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মুখপাত্র।
২০১৬ সালে ‘পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। বাংলা একাডেমির তৎকালীন ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালক শাহিদা খাতুন এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি জানান, একবারে এই স্বীকৃতি আসেনি, বরং তৃতীয়বার আবেদনের পর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই স্বীকৃতি পেয়েছিল।
শাহিদা খাতুন বলেন, এটা ছিল একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা আড়াই বছর ধরে ফাইল রেডি করেছি। আমরা শুধু ফাইল দিয়েছি আর হয়ে গেছে, এমনটা নয়। অনেক যাচাই-বাছাই হয়েছে। আমরা কেন হলো, কীভাবে হলো, কেন আমরা করতে যাচ্ছি - এসব বিষয়ে ১২১ জন আর্টিস্টের মতামত নিয়েছি। এটা মঙ্গল বা আনন্দের বিষয় নয়, বিষয় ছিল সম্প্রীতির বাংলাদেশ। এটা কিন্তু কোনো ইজম (মতাদর্শ) বা কোনো ধর্মের বিষয় নয়।
ইউনেস্কোর কাছে আবেদনের আগেও বেশ কয়েকবার নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল, এমন তথ্য জানিয়েছেন শাহিদা খাতুন। তিনি বলেন, আমরা টাইটেলটা অনেকবার বদলেছিলাম। প্রথমে আমরা দিয়েছিলাম পহেলা বৈশাখ। কিন্তু পহেলা বৈশাখ অনেক বড় একটা ব্যাপার। এর মধ্যে অনেক জাতিগোষ্ঠী জড়িত। এজন্য উনারা (ইউনেস্কো) আমাদের পরামর্শ দিলেন, এটা না দিয়ে আপনারা সুনির্দিষ্ট কিছু করেন।
উদ্যাপন পরিষদের প্রধান অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ অবশ্য নাম পরিবর্তনের বিষয়ে ১১ এপ্রিল গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, ১৯৯০ সালে যখন আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, তখন এর ভেতরে রাজনীতি ছিল। এখন নাম পুনরুদ্ধার করে আওয়ামীমুক্ত করা হলো।
তবে শাহিদা খাতুন জানিয়েছেন, ইউনেস্কোর কাছে নাম প্রস্তাবের সময় সবার মতামত নিয়েই করা হয়েছিল। আমাদের হাত দিয়ে যেটা প্রসব হয়েছে, সেটার প্রতি একটা মমত্ব তো থাকেই। তখন কিন্তু শুধু আমরা না, আমাদের সঙ্গে এই অঙ্গনে কাজ করা অনেক সুধীজন ছিলেন, দল-মতনির্বিশেষে আমরা এটা করেছি।
নাম পরিবর্তনে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ। তিনি বলেন, ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সেগুলো হচ্ছে, কালচারাল ডাইভারসিফিকেশন (সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য), ডায়ালগ (সংলাপ) এবং র্যালির বিউটিফিকেশন বা ভিজিবিলিটি (সৌন্দর্য বা দৃশ্যমানতা)। এগুলো ঠিক থাকলে ইউনেস্কোর কোনো বাধা নেই।
তবে এ বিষয়ে বিবৃতিতে অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষায় করা কনভেনশনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণের কথা উল্লেখ করেছে ইউনেস্কো। এই নীতিমালায় ১২টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘পার¯পরিক সম্মান’, ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে ‘স্বচ্ছ সহযোগিতা, সংলাপ, আলোচনা, পরামর্শ’।
সংস্থাটি বলছে, এই নীতিমালায় জোর দেওয়া হয়েছে ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গতিশীলতা এবং জীবন্ত প্রকৃতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্মান’ করার ওপর। পাশাপাশি ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা এটি অনুশীলনকারী সম্প্রদায়ের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে, এমন যেকোনো পদক্ষেপের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি, সম্ভাব্য এবং সুনির্দিষ্ট প্রভাব সাবধানতার সাথে মূল্যায়ন করা উচিত’ বলেও বিবৃতিতে জানিয়েছে ইউনেস্কো।
নাম পরিবর্তনের ফলে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, এ বিষয়ে ইউনেস্কোর বিবৃতিতে কিছু বলা হয়নি।
এখন পর্যন্ত ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ১৫০টি দেশের ৭৮৮টি ঐতিহ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের পাঁচটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০০৮ সালে বাউল গান, ২০১৩ সালে জামদানি শিল্প, ২০১৬ সালে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, ২০১৭ সালে সিলেটের শীতল পাটি এবং ২০২৩ সালে ঢাকার রিকশাচিত্র এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
এখন পর্যন্ত এই তালিকা থেকে কোনো ঐতিহ্যকে একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়ার উদাহরণ নেই। তবে কোনো ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়লে সেটিকে ‘জরুরি সুরক্ষার দাবিদার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ নামের আরেকটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইউনেস্কোর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে একাধিকবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং সংস্কৃতিসচিব মো. মফিদুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে এবং হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের আগ পর্যন্ত দেখা গেছে, বাংলাদেশের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটিই লেখা রয়েছে। -ডয়চে ভেলে