
গত ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রতি বছরই বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। এ বছরও পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘অদম্য নারী - শক্তিতে অজেয়’। চলতি বছর এই নারী দিবসটি এমন সময় আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে যখন দেশজুড়ে চলছে নারীদের অবমাননা।
প্রায় সময়ই আমরা শুনে থাকি নারী-শিশু নির্যাতন দমনের কথা। কিন্তু দিনে দিনে এই পরিস্থিতির কেন জানি অবনতিই ঘটে চলেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের মামলা হয়েছে দিনে ১২টি। আর এমন অনেক ঘটনা ঘটে যায় যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। এ মাসেই মাগুরায় আছিয়া নামে যে শিশুটি ধর্ষিত হয়েছিল অবশেষে তাকে বাঁচানো যায়নি।
প্রতিনিয়তই আমরা পথে-ঘাটে ইভটিজিংয়ের কথা শুনে থাকি। আমাদের মেয়েরা স্কুল-কলেজে যেতে বা ঘরের বাইরে বের হলেই ইভটিজিংয়ের শিকার হতে হয়। পরিণতিতে অনেকে স্কুলে-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এমনও হয় অভিমানে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে থাকে। অথচ আমাদের স্বাধীনতার পর এ যাবত কাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় নারীরাই ছিলেন অধিকাংশ সময়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, স্পিকার, চেয়ারম্যান এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে নারীদের পদচারণা হয়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও নারীরা এগিয়ে।
বেগম রোকেয়ার কথা আমরা ভালোই জানি। তিনি নারীদের উন্নয়নে প্রচুর পরিশ্রম করে গেছেন। তাঁর সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন নারীদের উন্নয়নে। তখনকার সময়ে নারীরা সমাজে চরম অবহেলিত ছিলেন। বেগম রোকেয়া ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে আসেন স্কুলে। তাই বেগম রোকেয়াকে বলা হয়ে থাকে নারী জাগরণের অগ্রদূত। তার রচিত ‘মতিচুর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’, ‘মতিচুর ২য় খ-’, ‘পদ্মরাগ’ কিংবা ‘অবরোধবাসিনী’ আজও আমাদের আলোর হাতছানি দেয়। আজ নারীদের যে জাগরণ তার পেছনে বেগম রোকেয়ার মতো নারীদের অবদান অনস্বীকার্য। এতোকিছুর পরও চোখ মেলে তাকালে দেখতে পাই নারীদের করুণ চিত্র। ক্ষমতায় নারী অথচ নারীদের আজ দুরবস্থা দেখলে শিহরিত হতে হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের জয় আমাদের গৌরবের বিষয়। অথচ জয়পুরহাট ও দিনাজপুরে নারী ফুটবল দলের ম্যাচ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নারী দিবসের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন আসে বৈকি। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত কিছুদিন ধরে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে একটি গোষ্ঠী দেশের নানা জায়গায় মাজার শরীফে সংঘবদ্ধ হামলা, ওরস আয়োজনে বাধা বা কনসার্টে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
সমাজে নানা ক্ষেত্রে এখনও নারীদের সাফল্যগাঁথা দেখতে পাই। এই কিছুদিন আগে ভারতের একজন নারী বাঁশি বাজিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। অলকা ঠাকুর নামে এই নারী বাঁশিতে পিএইচডি করেছেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর তাঁর জন্মস্থান। বাবার উৎসাহে তিনি বাঁশি শিখেছেন এবং এই গৌরব অর্জন করেছেন। সেদিন সংবাদপত্রে দেখলাম ভারতের কাশ্মীরে আয়েশা আজিজ নামে একজন নারী সর্বকনিষ্ঠ পাইলট হয়েছেন। কাশ্মীরের তিনি প্রথম সর্বকনিষ্ঠ পাইলট। এমন সুসংবাদ আমাদের আশ্বস্ত করে বৈকি।
নারীদের এতো সাফল্যের পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিয়সী নারী ক্লারা জেটকনের অবদান। নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে ১৫,০০০ শ্রমিকের একটি বিরাট সমাবেশ হয়। সেই থেকে শুরু আন্দোলনের। ‘সোসাইটি পার্টি’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে এই আন্দোলন প্রশাসনে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সেই থেকে প্রতি বছর ৮ মার্চ পৃথিবীর দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে নারী দিবস।
এখনও আমরা পত্রিকার পাতা উল্টালে দেখতে পাই প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও শিশু-নারী ধর্ষিত হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, খুন-হত্যা হচ্ছে। এ জন্য দেশে প্রচলিত আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন- নারীদের নির্যাতনের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তার কার্যকর বিহিত করুন।