
সন্ত্রাস অরাজকতার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যেখানে সামাজিক প্রথাপদ্ধতিসঞ্জাত নৈতিকতার সমূহ বিনাশ ঘটে এবং সেই সঙ্গে প্রশাসনিক আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, সেখানেই অরাজকতার প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশ এবংবিধ অরাজকতার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সমগ্র দেশের পরিসরে অরাজকতার এই ক্রান্তিলগ্নে সংঘটিত হাজার হাজার ঘটনার উদাহরণ একটু সচেষ্ট হলেই অনায়াশে সন্নিবেশন করা সম্ভব। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। হাতের কাছে গত শুক্রবারের (১৪ মার্চ ২০২৫) দৈনিক প্রথম আলো আছে। অরাজকতার মূর্তনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত হতে পারে এমন ঘটনার সংবাদশিরোনামগুলো এরকম : (১). তিন জেলায় পাঁচ শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, (২). পুলিশের উপর আক্রমণ না করার অনুরোধ আইজিপির (৩). ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বাবা-চাচাকে মারধর, (৪). ছাত্রদল নেতার বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ, (৫). চাঁদপুর : শিশুকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ, (৬). ‘আমার ঘরডা ভাইঙ্গা দিল, আমি অনে কই থাহুম’, (৭). তিনটি প্লান্টের মধ্যে দুইটি বন্ধ, (৮). নিখোঁজ চালকের মরদেহ পড়ে ছিল ধান খেতে, (৯). প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে নেতাদের বাড়ি দখল।
সারা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই দৃষ্টান্তগুলো সামান্য বটে, কিন্তু তাৎপর্যবহ। কেন না এগুলোতে নৈতিকতার অবসান, আইন অবজ্ঞা, বিমানবিকতা, হিং¯্রতা, আত্মপরতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ইত্যাদির নিরিখে সামাজিক সুস্থতার অবক্ষয় পূর্ণমাত্রায় প্রকটিত, যার ভেতরে বিশেষত প্রশাসনিক সুস্থতার অবক্ষয়ের মাত্রাটা যৎপরোনাস্তি বেশি। দেশের এমন অবস্থা অবশ্যই একটি সমাজবাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। যে-সমাজবাস্তবতা প্রতিপন্ন করে যে এখানে বিদ্যমান আর্থসামাজিক বিন্যাসকাঠামোর পরিসরে অরাজকতা ভয়াবহ আকারে বিস্তৃত হয়ে কাঠামোগত সহিংসতায় পর্যবসিত হয়েছে, যে কাঠামোগত সহিংসতা ব্যক্তিগত সম্পদসঞ্চয়ের পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থার উপর নির্ভর করে টিকে আছে। এবার সুনামগঞ্জ সদরের পরিপ্রেক্ষিতে একটি দৃষ্টান্ত হাজির করা যাক।
এখানকার একটি দৈনিকের (দৈনিক সুনামকণ্ঠ) একটি সংবাদপ্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, “বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের ইজারাবিহীন ধোপাজান-চলতি নদীর তীরে ৩ ফসলি জমি (শিম ক্ষেত) থেকে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনে বাধা দেওয়ায় জমির মালিক কৃষক ফরিদ মিয়াকে বেধড়ক মারপিট ও কুপিয়ে জখম করেছে বালুখেকোরা। তিনি সলুকাবাদ ইউনিয়নের কালীপুর ডলুরা গ্রামের মরহুম ধনু মিয়ার ছেলে। সোমবার ডলুরা কালীপুর চলতি নদীর তীরে এই ঘটনা ঘটে। জানা যায়, সোমবার সকালে বালু-পাথরখেকো সিন্ডিকেট ড্রেজার দিয়ে কৃষক ফরিদ মিয়ার (৩৮) জমি থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করছিল। এসময় তিনি বাধা দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে বালু-পাথরখেকোরা।”
আপাতত আর উদাহরণের বহর না বাড়িয়ে বলতে চাই, এমতাবস্থায় কেবল কৃষক ফরিদ মিয়া নয়, বরং সমগ্র দেশের মানুষ আসলেই নিরাপত্তাহীনতায় বেঁচে আছেন। এই অরাজক পরিস্থিতির অবসান চাই।
জানি অচিরেই তা হবে না, হবার কথাও নয়, বরং অদূর ভবিষ্যতে জননিরাপত্তা আরও বেশি করে বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কাকে একেবারে নিশ্চিত হয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আপাতত কেবল কৃষক ফরিদ মিয়া ও তার এলাকার মানুষজনকে নিরাপত্তা দিন, অরাজক অবস্থার পরিসরে কাঠামোগত সহিংসতায় পড়ে তাঁদের জীবন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। কৃষকের ফসলি জমিকে বালুপাথরখেকো মাফিয়াচক্রের হাত থেকে রক্ষা করুন।