
এ বিশ্ব জগতের মালিক মহান আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমত নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। ‘রমজান’ শব্দের অর্থ ‘পুড়িয়ে ফেলা’। সূর্যোদয়ের পূর্ব হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার এবং সকল প্রকার কুপ্রবৃত্তি হতে নিজেকে মুক্ত রাখার নামই রোজা। আল্লাহ তা’আলাকে রাজিখুশি করার যত প্রকার ইবাদত বন্দেগী আছে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে রোজা। কঠিন এই অর্থে যে, আল্লাহ তা’আলার হুকুম পালন করতে গিয়ে নিজের উপর নিজেরই সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা। হাতের কাছে আছে, ইচ্ছে করলেই উপভোগ করা যায়- পৃথিবীর কোনো প্রাণী টের পাবে না; অথচ তা আমরা করি না। কেননা, মহান আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই দেখছেন, শুনছেন, জানছেন তিনি এমনই অসম্ভব শক্তিধর। রোজাব্রত পালনের আসল মাহাত্ম্য এখানে। সারাদিন কিছুই খাওয়া যাবে না। মিথ্যা বলা যাবে না। অন্যের সমালোচনা করা যাবে না, যৌন সম্পর্ক করা যাবে না, চোখ, কান, হাত, পা এমনকি মনের মধ্যেও তৈরি করতে হবে কেবল প্রয়োজনীয় পরিবেশ। এটিই হচ্ছে রোজা।
পৃথিবীতে আমরা কখনো কিছু আগুনে পুড়িয়ে ফেলে সেখানে আবার সম্পূর্ণ নতুন করে যেমন তৈরি করি, ঠিক তেমনই প্রকৃত রোজা পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের শরীর-মনের সমস্ত খারাপ দিক বাদ দিয়ে একটি নিষ্কলুষ পরিবেশ তৈরি করি যা আল্লাহ নির্দেশিত। এখানে চোখের দৃষ্টিকে বৈধ পথে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। হাত-পায়ের আচরণকে সীমিত করা হয়েছে। মুখ ও মুখের কথাবার্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। সকল প্রকার যৌন সম্পর্ক এমনকি বৈধ ক্ষেত্রেও বাতিল করতে বলা হয়েছে। পানাহার থেকে বিরত থাকার কথা তো সবার আগেই বলা হয়েছে। তাহলে এমন যদি হয়, তবে একজন মানুষের আর থাকে কি? খুব সহজ কথায় নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়া। এটিই রমজানের শিক্ষা, এটিই রমজানের গুরুত্ব। এভাবেই হয় আত্মশুদ্ধি। একজন মানুষ যখন ধারাবাহিকভাবে পর পর ত্রিশ দিন এমন সাধনায় সিদ্ধহস্ত হয় তখন সেই মানুষটির মধ্যে বোধের সৃষ্টি হয়। এই বোধ একজন বিশ্বাসীর ইহকাল ও পরকালে সফলতা এনে দেয়। ক্ষণিক এই পৃথিবীতে এই মানুষটির দ্বারা কোনক্রমেই কোনো অশান্তি সৃষ্টির সুযোগ থাকে না। এ জন্যই আল্লাহ তা’আলা যুগে যুগে তার প্রিয় মানুষদের অর্থাৎ নবী-রাসুলদের পৃথিবীতে প্রেরণ করে এই অমর বাণী ও আদর্শ প্রচার করেছেন। পবিত্র মাহে রমজান থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই। আর এ কারণেই রমজান মাসকে আরবি অন্যান্য মাসের উপর মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এ মাসেই নাজেল হয়েছে হযরত ইব্রাহিম আ.-এর ‘সহিফা’, হযরত মুসা আ.-এর উপর ‘তাওরাত’, হযরত ঈসা সা.-এর উপর ‘ইনজিল শরীফ’ এবং হযরত দাউদ আ.-এর উপর ‘যাবুর’। মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজেল হয়েছে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ মোস্তাফা সা.-এর উপর। এ মাসেই রয়েছে ‘শবে কদর’ নামে এমন রাত যে রাতের ইবাদত বন্দেগী হবে হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। আত্মশুদ্ধির জন্য রোজা যেমন ফল দেয়, তেমনি কাজ করে পরকালে ‘দোজখের ঢাল স্বরূপ’। একথা মহানবী সা.-এর।
যুদ্ধের ময়দানে ঢাল যেমন তীর তলোয়ারের আক্রমণকে প্রতিহত করে, তেমনই দোজখ থেকে রক্ষা করে রোজা। মাহে রমজানের এই অশেষ অবদানকে আমরা অবহেলায় নষ্ট হতে দেবো না। পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনে দু’দ- শান্তি পেতে এবং আখেরাতে অনন্ত জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ও চিরসুখ লাভের আশায় আমরা মাহে রমজানের রোজা পালনে সচেষ্ট হবো - অঙ্গীকার করছি। নিজেকে পরিপূর্ণ মানবে পরিণত করতে আত্মশুদ্ধির আর শ্রেষ্ঠতম উপায় এর চেয়ে অন্য কিছুই হতে পারে না। এই লক্ষ্যে আমরা পরিশ্রম করবো পবিত্র কোরআন সুন্নাহ’র আলোকে সারা বছর - বিশেষ করে মাহে রমজানে। মহান রাব্বুল আ’লামিন আমাদের কবুল করুন।