শামস শামীম ::
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণের কারণে বন্যাঝুঁকির অঞ্চল হাওর-ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলা। প্রতিবছরই মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যায় জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতির। এর মধ্যে জীবনমান উন্নয়নের জন্য উন্নয়নযজ্ঞও চলছে। কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়নও এখন গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘনঘন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে হাওরবাসী। তাই জেলার অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প ‘মদনপুর-দিরাই-শাল্লা-জলসুখা-আজমিরিগঞ্জ মহাসড়ক’ প্রকল্পে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা চিন্তা করে পানি নিষ্কাশনের পথ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছেন হাওরের প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকা অভিজ্ঞ লোকজন। সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগও পরিবর্তিত প্রাকৃতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে হাওরের মধ্য দিয়ে নির্মিত দুটি জেলা (সুনামগঞ্জ-হবিগঞ্জ) নিয়ে বিস্তৃত সড়কটিতে সেতু ও কালভার্টের সংখ্যা বাড়িয়ে নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে।
সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দুর্গম হাওর উপজেলা শাল্লা উপজেলাকে সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকল্পের কাজ কিছুটা করার পর অসমাপ্ত রেখেই ২০১৭ সালে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। এই কাজ এগিয়ে নিতে ২০২২ সালের ১৬ জুন একনেকে ‘মদনপুর-দিরাই-শাল্লা-জলসুখা-আজমিরিগঞ্জ মহাসড়ক’ এর দিরাই-শাল্লা অংশ পুনঃনির্মাণ একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর আগে ২০১৯ সালে শাল্লা-আজমিরিগঞ্জ সড়ক নির্মাণে আরেকটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন করে কাজ শুরু হয়। এই সময়ে ঘনঘন কয়েকটি বন্যায় সড়ক, কালভার্ট ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্টরা পানি নিষ্কাশনের জন্য আরো কালভার্ট ও সেতু নির্মাণে গুরুত্ব দেন। বিশেষ করে দিরাই-শাল্লা সড়কটি সম্প্রতি জুন ও জুলাই মাসের বন্যায় আবারও তৃতীয় দফা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। বানের পানির তোড়ে ও হাওরের ঢেউয়ে ধসে গেছে সড়কের বেশিরভাগ এলাকা। এই অংশেও পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন করে আরো সেতু ও কালভার্ট বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এই সড়কটির কাজও চলমান আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রথমে ‘মদনপুর-দিরাই-শাল্লা-জলসুখা-আজমিরিগঞ্জ মহাসড়ক’ প্রকল্পের প্রথম বরাদ্দ ছিল ৭৬৯ কোটি টাকা। পরবর্তীতে নতুন নকশা করে ৯৯৮ কোটি টাকার বরাদ্দ করা হয়। শাল্লা-জলসুখা সড়কটি ১৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ অংশে ১০ কিলোমিটার এবং হবিগঞ্জ অংশে ৬ কিলোমিটার। বন্যার কথা বিবেচনা করে এখানে বিশেষ বিবেচনায় পানি নিষ্কাশনের জন্য কালভার্ট ও সেতু বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে সড়ক বিভাগ। ২০২২ সালের বন্যা বিবেচনায় নিয়ে সড়কের নকশায়ও পরিবর্তন এনে উঁচু করা হয়েছে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, এই সড়কে মোট সেতুর সংখ্যা ১১টি, কালভার্টের সংখ্যা ৪২টি। এই সড়কটিতে বন্যায় পানি নিষ্কাশনের কথা বিবেচনা করে প্রতি ৩০০ মিটার পরপরই সেতু রাখা হয়েছে। জানা গেছে, আগের নকশায় যেখানে কালভার্ট ছিল ১০ ফুটের সেখানে করা হয়েছে ৪০ ফুট। এভাবে সেতুর দৈর্ঘ্যও বড় করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঘনঘন বন্যার কারণে আরো ২ বছর বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৮ জুন সড়ক ও সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী বন্যা পরিদর্শনে এসে বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মতনিবিনিময় সভায় বসেন। এখানে তিনি বন্যার পানি দ্রুত সরানোর জন্য কালভার্ট ও সেতুর মুখ দখল/বন্ধ হয়ে থাকলে দ্রুত অপসারণের নির্দেশ দেন। এই অনুষ্ঠানে স্থানীয় সুধীজন নির্মিতব্য দিরাই-শাল্লা ও আজিমিরিগঞ্জ-শাল্লা সড়কেও পানি নিষ্কাশনের জন্য কালভার্ট ও সেতুর পরিমাণ বাড়ানোর দাবি জানান।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে প্রাণ ও প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে অতীতে প্রকল্প নেওয়া হয়নি। তড়িঘড়ি করে সড়ক ও সেতু নির্মাণ করায় প্রকৃতি ঘনঘন অভিশাপ দিচ্ছে। সড়ক ও সেতু ধসে যাচ্ছে। তাছাড়া হাওরের মধ্যখান দিয়ে প্রবাহিত সড়কে পানি নিষ্কাশনের পথ কম থাকায় সড়ক ভেঙে যাচ্ছে। তাই হাওরে সড়ক অবকাঠামো করার আগে স্থানীয় অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হলে দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতি কমতো।
শাল্লা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট অবনী মোহন দাস বলেন, দিরাই-শাল্লা সড়কে প্রথমে পানি নিষ্কাশনের পথ কম ছিল। যার কারণে বন্যার পানির চাপে কয়েকটি বন্যায় সড়ক ও সেতুগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমরা শাল্লা-আজমিরিগঞ্জ সড়ক নির্মাণের আগে পানি নিষ্কাশনের পথ বাড়ানোর দাবি করেছিলাম। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে হাওরের অভিজ্ঞদের সাথে নিয়ে হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সড়কটিতে পানি নিষ্কাশনের পথ বাড়ানো হয়েছে।
সুনামগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম প্রাং বলেন, দিরাই-শাল্লা সড়ক ও শাল্লা আজমিরিগঞ্জ সড়ক দুটিতেই বন্যা দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে পানি নিষ্কাশনের পথ বাড়ানো হয়েছে। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যা বিবেচনায় নিয়ে সড়কও উঁচু করা হয়েছে। নকশায় পরিবর্তন এনে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সড়ক দুটির কাজ চলছে। বর্তমানে শাল্লা আজমিরিগঞ্জ সড়কের প্রায় ৬০ ভাগ কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।