
আকরাম উদ্দিন ::
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্গত ‘ধামালিয়া মরাগাঙ’ নামক শুকিয়ে যাওয়া নদীর তীর ও তলদেশের বালু-পাথর লুটপাটের মহোৎসব চলছে। যে যেভাবে পারছে লুটে নিচ্ছে এই সম্পদ। ফলে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সরেজমিনে দেখাগেছে, ধামালিয়া নদী এলাকাজুড়ে প্রায় ৩ শতাধিক কোয়ারি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি কোয়ারির গর্ত অন্তত ৩০ ফুট গভীর। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলনে নদীর বুক ক্ষত-বিক্ষত করেছে স্থানীয় অসাধু বাসিন্দারা। অর্থের লোভে অদূর ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে মাসের পর মাস বাড়ির সামনের অংশে নদীর সীমানা দখল করে বালু-পাথর উত্তোলন করে বেচাকেনার ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
এদিকে, নদী থেকে অবাধে বালু-পাথর উত্তোলনের কারণে প্রায় ৫ সহস্রাধিক বাড়ি, সরকারি পাকা সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানীয় সচেতন বাসিন্দারা জানান, অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলনের ফলে ধামালিয়া মরাগাঙ নদীর তীরে অবস্থিত মথুরকান্দি, পশ্চিম ডলুরা, কালীপুর ডলুরা, আদাং, চেংবিল, রতারগাঁও, উত্তর কাপনা, দক্ষিণ কাপনা, পূর্বকাপনাসহ আরও অনেক গ্রাম ভাঙন হুমকির মুখে পড়েছে। এসব গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বালু-পাথর সংরক্ষণের জন্য মাসের পর মাস জায়গা ভাড়া দেয়ার ব্যবসাও চলছে। প্রতিদিন ও রাতে স্থানীয়ভাবে এবং শহরতলির বিভিন্ন ডাম্প পিকআপ, ট্রলি, অটোরিকশা করে বালু-পাথর ডাম্পিং করে বেচাকেনা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতি ফুট পাথর ব্যবসায়ীরা ক্রয় করছেন ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা করে। প্রতি ট্রলি বালু ৮০০ শত টাকা করে ক্রয় করছেন ব্যবসায়ীরা। নদী থেকে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু-পাথর সংশ্লিষ্টরা তাদের বাড়ির আঙিনায় বিক্রির জন্য ডাম্পিং করে রেখেছেন। এসব বালু-পাথর নিলামে বিক্রি করলে কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব পাবে সরকার। এছাড়া পিকআপ, ট্রলি চলাচলের কারণে ধূলিকণা উড়ে এলাকার পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এলাকায় বাড়ছে হাঁচি, কাশি ও এলার্জিজনিত রোগ।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, দেশ স্বাধীনের আগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী উত্তর কাপনা ও চেংবিল এলাকায় ভারতের সীমান্তে বাঁধ দেয়া হয়। এরপর থেকে চলতি নদীর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পানিশূন্য হয়ে মরাগাঙে পরিণত হয় এই ধামালিয়া নদী। এখন বর্ষায় এই নদী দিয়ে শুধুমাত্র পটইখালি থেকে মেঘের পানি মিনাজুরী হয়ে খরচার হাওরে প্রবাহিত হয়। কিন্তু এই ধামালিয়া নদী প্রায় পুরো বছর পানিশূন্য থাকে। এছাড়াও জিগাতলা, কাপনা গুচ্ছগ্রাম, বাচ্চুর বাড়ির চৌরাস্তা, লক্ষ্মীপার, পাহাড় বিলাস এলাকা থেকে এসব বালু-পাথর বিভিন্ন সময় উত্তোলন করা হয়েছে। এখন নিজের দখলীয় বাড়িতে দীঘির ন্যায় খনন করে লক্ষ লক্ষ টাকার মূল্যবান পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।
উত্তর কাপনা এলাকায় নুর মিয়ার বাড়িতে এভাবে দীঘি খনন করে দিনে ও রাতে পাথর উত্তোলন করে লক্ষ লক্ষ টাকা বিক্রি করছেন। একইভাবে মতিউর রহমান, শফিকুল ইসলামসহ অসংখ্য লোকজন গত কয়েক মাস ধরে ধামালিয়া নদী থেকে পাথর ও বালু উত্তোলন করে জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে আসছেন।
কাপনা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, গ্রামের বাসিন্দারা প্রথম অল্প অল্প করে বালু-পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করতেন। এখন দিনে রাতে পাথর উত্তোলনে পড়ে থাকেন ধামালিয়া নদীতে। কে কাকে বাধা দেবে সবাই পাথর ও বালু উত্তোলন করছে।
কাপনা গ্রামের বাসিন্দা সেজুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তান আমলে ভারতের সীমান্ত এলাকায় বাঁধ দেয়ায় এই নদী শুকিয়ে যায়। তখন চলতি নদীর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভারত বৃষ্টি হলে উপচে উঠে বাঁধের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয় আমাদের ধামালিয়া নদীতে।
দক্ষিণ কাপনা গ্রামের পাথর উত্তোলনকারী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় প্রায় ৩/৪ হাজার মানুষ বালু-পাথর উত্তোলন করছে। সবাই উত্তোলন করছে তাই আমরাও তুলছি।
একই গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, আমাদের এলাকায় ধামালিয়া নদীতে আমরা বালু-পাথর উত্তোলন করছি। বাইরের কেউ নন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাহেদ আলী বলেন, গত কয়েক মাস আগে একটি সরকারি সড়কের মেরামত কাজের জন্য এস্কেভেটর দিয়ে বালু-পাথর উত্তোলন করে নেয়। এ থেকে স্থানীয় মানুষেরা সাহস পেয়ে বেশি বেশি করে হাত দিয়ে বালু-পাথর উত্তোলন শুরু করে এবং তা বিক্রি করে। মাত্র কয়েক মাসে নদীর এই বেহাল অবস্থা হয়েছে। বালু-পাথর বিক্রি করে এখন সবাই লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক।
দক্ষিণ কাপনা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী অঞ্জু মিয়া বলেন, এই এলাকায় সবার বাড়ির সামনে নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করছে। তাই আমিও করছি। সরকার বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ করলে সবারই বন্ধ হবে।
মথুরকান্দি এলাকার আব্দুল আহাদ বলেন, আমরা বালু-পাথর বেচাকেনার ব্যবসা করছি। আমরা পাথর উত্তোলন করি না।
পূর্ব কাপনা এলাকার বাসিন্দা ফয়েজুল হক বলেন, মানুষ বাঁচার তাগিদে বালু-পাথর উত্তোলন করছে। অন্তত দেড় মাস আগে থেকে ধামালিয়া নদীতে বালু-পাথর উত্তোলন শুরু হয়েছে।
একই এলাকার বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, কৃষি কাজ করে আমরা সংসার চালাই। এখন অনেকে তাদের বাড়ির সামনে নদী দখল করে গভীর থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করছে। আমরা বালু-পাথর উত্তোলন করি না।
পশ্চিম ডলুরা গ্রামের বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, আমরা সামান্য বালু-পাথরের ব্যবসা করি। ধামালিয়া নদীতে প্রায় ৫ হাজার পরিবার বালু-পাথর উত্তোলন করছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু তাহের বলেন, ধামালিয়া নদীতে হঠাৎ করে বালু-পাথর উত্তোলন শুরু হওয়ায় উত্তোলনকারী ও ব্যবসায়ীরা খুশি। কিন্তু পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সরকারি স¤পদ রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু আমাদেরও সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত।
সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম সদরুল বলেন, চলতি নদীর পরে এখন ধামালিয়া নদীতে চলছে বালু-পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। এসব বালুখেকোদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। একই সাথে দ্রুত সরকারি স¤পদ রক্ষা করা জরুরি প্রয়োজন।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ধামালিয়া নদীতে বালু-পাথর উত্তোলন হচ্ছে বিষয়টি বুধবার জেনেছি। ওসি সাহেবের সাথে কথা বলে স্থায়ী পুলিশের চেকপোস্ট বসানো যায় কি-না বিষয়টি দেখছি।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধামালিয়া নদীতে বালু-পাথর উত্তোলন হচ্ছে, এটা আমি প্রথম শুনলাম। এই বালু-পাথর যদি কোনো বৈধ কোয়ারি থেকে উত্তোলন করা না হয়, তবে নিলামের প্রক্রিয়া আছে। সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা যায়। যদি বাজেয়াপ্ত করা যায়, তবে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ইউএনওকে বলে দেবো নিলামে বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে।