
দিনে দিনে ছোট্ট শহরের স্বাভাবিক পরিবেশ আর ঠিক থাকছে না। যে শহর বিংশ শতাব্দীতে ছিলো প্রাকৃতিক পরিবেশের মায়ার শহর পরিচ্ছন্ন শহর সেই সুন্দর আর নাই। এখানে এখন আর বাসার সামনে সারি সারি সুপারি গাছ, নারিকেল গাছ, আম গাছ, কাঁঠাল গাছ নাই, কদম গাছও আগের মতো দেখা যায় না। রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলতো ছোটো খাল, তা আর নাই। এই শহরে এখন আর দুপুর বেলা কাঠঠোকরা ডাকে না, বরই গাছে বুলবুলির হৈ-হুল্লোরের আওয়াজ পাওয়া যায় না, ঘরের বারান্দায় কিংবা বাগানে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়–ই পাখিরা উড়ে আসে না। এখন বাসা আছে বাগান নাই। মহল্লায় মহল্লায় শিশু কিশোরের খেলা নাই। খেলবে কোথায়? পর্যাপ্ত মাঠ নাই। শহরে কাকের উড়াউড়ি খুব বেশি চোখে পড়ে না, এমনকি শহরে এখন আর শালিক, দোয়েল, চড়–ইদের ঝাঁক দেখা যায় না। যে শহর দেখতে ছিলো সবুজ পাতার ছাতায় ঢাকা এখন সে শহরের চারতলা - পাঁচতলা বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আর সবুজে ছাওয়া চোখজোড়ানো সৌন্দর্য দেখা যায় না। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও এ শহরের প্রধান প্রধান সড়কে ও পাড়া-মহল্লায় চলতে চলতে গাছের ডালে ডালে পাখিদের চঞ্চলতা দেখা গেছে, কিন্তু তা আর আগের মতো নাই। তবে শহরের কালীবাড়ি, উকিলপাড়া, বাঁধনপাড়া, বিলপাড়, ষোলঘর, জামাইপাড়া, নতুনপাড়া, মধ্যবাজার, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, হাছন নগর, ধোপাখালী থেকে ওয়েজখালি সর্বত্র অলিগলিতে এমনকি প্রধান সড়কে ও সড়কের পাশে বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে। এমতাবস্থায় সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ আছে বলা যায় না। এই ছোট্ট জেলা শহরের পাড়া মহল্লায় কিংবা বিগত বছরগুলোতে হাছননগর এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি এসসি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় সংলগ্ন সড়কে, উকিলপাড়া নদীর পাড়ে যে অল্প কিছু সুন্দর ফুটপাত বা ওয়াক ওয়ে হয়েছে সেখানে খুব ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় হাঁটতে গেলে প্রথমেই বেওয়ারিশ কুকুর মোকাবেলা করতে হয়। এখানে সকালে শিশুদের স্কুল ও মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় শিশুরা রাস্তার পাশে দলবদ্ধ কুকুর দেখে ভয় পায় এবং মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক শিশু ভয়ে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। দলবদ্ধ কুকুর যখন গলির মোড়ে বিভিন্ন বাসার কাছে দাঁড়িয়ে ঘেউঘেউ করে তখন শিশুদের অভিভাবকদের অনেককেই ভয়ে জড়সড় হয়ে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। সকালে কিংবা বিকেলে বাজার থেকে পণ্য কিনে বাসায় ফিরার সময় হাতে বাজারের থলে দেখে কুকুরের দল ঘেউঘেউ করে এমনভাবে এগিয়ে আসে মনে হয় যেনো সবকটা মিলে বাজারের থলে টেনে নিয়ে যাবে। অনেক সময় বাজারের থলে এমনকি প্যান্টের গা ঘেঁষে বা মুখ লাগিয়ে লালা দিয়ে ময়লা করে ফেলে। অনেককে সন্ধ্যার পরে নানান কাজে বের হতে হয় এবং ফিরতে হয় রাত করে। শহরে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এমতাবস্থায় রাতে দশটা কিংবা এগারোটায় বাইরে থেকে বাসায় ফিরতে আতঙ্ক কাজ করে দেহে মনে। হয় কোনো বড়ো রাস্তার ফুটপাত থেকে না-হয় কোনো গলির ভিতর থেকে ঘেউঘেউ করে তেড়ে আসে বেওয়ারিশ কুকুরের দল। বেওয়ারিশ কুকুরের কোনো মালিকানা নাই এবং যখন-তখন দলবদ্ধ হয়ে ঘেউঘেউ চিৎকারে ভয় জাগানো পরিবেশ সৃষ্টি করে রাতের ঘুমও নষ্ট করে। এ সমস্যা মূলত নাগরিক জীবনের অনেক সমস্যার একটি বড়ো সমস্যা। দেখার যেন কেউ নেই! গেল বছরের ছাত্রজনতার আগস্ট বিপ্লবের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়ার পরে সারাদেশের ন্যায় স্থানীয় সরকার পরিষদ পৌরসভা ভেঙে দেয়া হয়। কার্যত বর্তমানে শহরের নাগরিকদের এসব সমস্যা দেখাশোনার জন্য বিভিন্ন ওয়ার্ডের কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নাই কিংবা সর্বসাধারণ নাগরিকদের পক্ষে সরাসরি কোনো জনপ্রতিনিধির কাছে গিয়ে সমস্যার কথা জানানোর সহজ উপায় নাই। যেতে হয় অফিসে। কিন্তু, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত মূল অফিস থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সকল মানুষের পক্ষে সবসময় সেখানে গিয়ে অভিযোগ করা স্বাভাবিক গতিতে সম্ভব হয় না। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বসাধারণের সমস্যা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর এক অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে বিভিন্ন পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। সমস্যা অনেক। প্রধান রাস্তা ও ড্রেন ভাঙাচোরা, কোথাও ড্রেন আছে বলে দৃশ্যমান হয় না। অলিগলির অবস্থা আরও বেশি খারাপ। ময়লা জমে থাকতে থাকতে মশা-মাছি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথাও কোথাও দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে রুমাল দিয়ে পথটুকু পারি দিতে হয়। এভাবেই সুন্দর সাজানো একটি শহরের সৌন্দর্য চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক বৃষ্টি না-হওয়ার কারণে শহরের বাতাসে ধুলো উড়ে বেড়ায় এবং এতে করে শিশু বৃদ্ধ সহ সকল নাগরিকের অসুস্থতা বেড়েছে অনেক। শহরের প্রধান প্রধান সড়কে সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখে, কেজি স্কুলের সম্মুখে, বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়মিত পানি ছিটানোর উদ্যোগ না- নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর কিছু দিন পরে শুরু হবে বৃষ্টির মৌসুম। তার আগেই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা যেটুকু আছে তা সংস্কার করার পাশাপাশি নতুন নতুন ড্রেন নির্মাণ করতে হবে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করতে হবে। ড্রেনের ময়লা তুলে রাস্তার পাশে জমা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাখা যাবে না। এতে করে পরিবেশ দূষণ ঘটে। শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার ও রাস্তার উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ একটি নিয়মিত ব্যাপার, এটা প্রতিনিয়ত সংস্কার করতে হয়। বিভিন্ন রাস্তায় সন্ধ্যার পরে বাতি জ্বলে না, এতে দুষ্টুদের দুষ্টুমি ও ছিনতাই করার সুযোগ বাড়ে। বিভিন্ন মহল্লার প্রবেশ মুখে বাতি জ্বলে না সেজন্যে গাড়ি চলাচল করতে মোড় নেয়ার সময় ও পায়ে চলাচলের পথচারীদের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। আর এসব মোড়ে মোড়ে বেওয়ারিশ কুকুরের আড্ডা যেমন জমে তেমনি অন্ধকারে ছিনতাইকারী ও ছিঁচকে চোরের দলও ওঁৎ পেতে থাকে। শহরের বহু রকম দূষণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। শব্দ দূষণ মারাত্মক হুমকি হয়ে গেছে। অকারণে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলে অটোরিকসা, মোটর সাইকেল। কোনো কোনো মোটরসাইকেল আবার বেপরোয়া গতিতে বিকট শব্দ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দিয়ে এমনকি প্রধান সড়কে আতংকিত পরিবেশ সৃষ্টি করে চলে কোনো রকম নিয়মের তোয়াক্কা না-করে। যারা চালায় তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কি-বা নাই! এসব বিষয়ে আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি। শেষ করছি- আমাদের খেলার মাঠে বাণিজ্য মেলা, পশুর হাট ইত্যাদি না করে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল কথা হচ্ছে নাগরিকদের সুবিধার জন্য অতি জরুরি ভিত্তিতে শহরে বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাত বন্ধ করতে হবে, নিয়মিত ময়লা আবর্জনা সাফ করতে হবে এবং মোটামুটি স্বাভাবিক পরিবেশে যাতে নাগরিকদের পথচলা সহজ হয় সেদিকে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নিতে হবে। চাই পরিচ্ছন্ন শহর। সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিক জীবনের জন্য এই দাবি সকল মানুষের। [লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক]