
আব্দুল্লাহ আল মামুন ::
হাওরবেষ্টিত উপজেলা জামালগঞ্জে অসংখ্য ছোট বড় হাওর, নদী-নালা, খাল-বিল রয়েছে। এক সময় দেশীয় মাছে ভরপুর ছিল জামালগঞ্জ। রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, শোল-গজার, কালি বাউশ, টেংরা, পাবদা, শিং-মাগুর ও বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছসহ অসংখ্য জীববৈচিত্র্যের ভা-ার ছিল উপজেলাটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং মনুষ্য সৃষ্ট কারণে হারিয়ে যাচ্ছে হাওরের দেশীয় মাছের ভা-ার। অনেক প্রজাতির মাছ এরই মধ্যে বিলুপ্তি হয়েছে। আরো অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। প্রতিবছর মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, চায়না দুয়ারীসহ কারেন্ট জাল ও বিল শুকিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে হাওরের মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য। এখন দেশীয় মাছ ও শামুক -ঝিনুক, কচ্ছপসহ নানা প্রজাতির প্রাণী তেমনটা চোখে পড়ে না। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ইজারাদার ও সুবিধাভোগী দল সেলু মেশিন বসিয়ে বিল শুকিয়ে মাছ আহরণ করছে। এমনকি বিলের তলা শুকিয়ে কাদা মাটির গভীর থেকে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে মাছ বের করে বংশ নিপাত করছে।
বিগত সরকার ব্যক্তির নামে ইজারা প্রথা বাতিল করে মৎস্যজীবী সমিতির নামে ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে। যাতে করে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো, মৎস্যজীবী সমিতির নামে বিল নিয়ে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে সুবিধাভোগী। নামমাত্র টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় অনেক সমিতি। বছরের পর বছর ধরে চলছে মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য নিধন। প্রশাসনের চোখের সামনে মৎস্য আইন ভঙ্গ করে ছোট বড় সরকারি বিল শুকিয়ে মাছ আহরণ করছে সুবিধাভোগিরা। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে মধ্যে দু-একটা অভিযান পরিচালনা করলেও তা ‘লোক দেখানো’। বর্তমান সরকারের আমলেও ধারাবাহিকভাবে বিল শুকানো চলমান রয়েছে।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানাযায়, জামালগঞ্জ উপজেলায় ২০ একরের নিচে ৪১ টি বিল যার আয়তন ১৫৬.৩০ হেক্টর ও বিশ একরের উপরে ৩৯ টি বিল যার আয়তন১৯১১.৩০হেক্টর রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার দিঘা, বাইম দাইর, গঙ্গাধরপুর নদী জলমহালের একাংশ (উরা বিল) শুকিয়ে মাছ আহরণ করা হয়েছে। একের অধিক সেলু মেশিন বসিয়ে বিল শুকানো চলছে দিরাই-চাতল গ্রুপ, আয়লা-ছাগাইয়া গ্রুপের চিনাইধরা, ধলাপাকনা, ঢালিয়া ও নয়াখাল নাইন্দা জলমহালে।
দিরাই চাতল বিলের ইজারাদার হরিনগর-নোয়াগাঁও-নলোয়ারপাড়-জগন্নাথপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ স¤পাদক সাহাব উদ্দিন বলেন, ছয় বছরের জন্য উন্নয়ন স্কিমে দিরাই চাতল বিল পেয়েছি। বিল ভরাট ও মাটিতে গ্যাস হওয়ার কারণে মাছ থাকে না। বিল খননের জন্য ডিসি স্যার, জামালগঞ্জের ইউএনও স্যার ও মৎস্য স্যার অনুমোদন দিয়েছেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে খনন কাজ শেষ করব।
উল্লেখ্য, গত দুই বছরও (২০২৩-২৪) খননের কথা বলে বিল শুকিয়ে মাছ আহরণ করা হয়েছে। অথচ জলমহালে কোন খনন কাজ করা হয় নাই। বার বার ইজারা আইন ভঙ্গ করছে উক্ত মৎস্যজীবী সমিতি আরও অন্যান্য বিলসমূহ।
পাগনার হাওরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৎস্যজীবী বলেন, আমরা বর্ষায় মাছ ধরলে জাল পুড়ানো হয়। এখন বিল শুকাইয়া মাছ ধরের তারার কুনতা হয় না। টাকা থাকলে সব কিছু করা যায় এ দেশে। কয়দিন পরে হাওরে আর মাছ পাওয়া যাইত না। বিষ মাইরা মাটির তল তকি মাছ বের করে। এখন তো আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না।
সমাজকর্মী মো. আব্দুর রব বলেন, হাওরের মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পথে। ইজারাদার বিল শুকিয়ে অবাধে মাছ আহরণ করছে। যারা বিল শুকাচ্ছে তাদের শক্তির উৎস কোথায়। এভাবে বিল শুকিয়ে মাছ ধরলে দেশীও প্রজাতির মাছ ও জীববৈচিত্র্য চিরতরে হারিয়ে যাবে। যে সমস্ত সমিতি ইজারা আইন ভঙ্গ করে তাদের প্রতিহত করতে হবে। প্রশাসনকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
জামালগঞ্জ উপজেলা মৎস্য অফিসার (চলতি দায়িত্ব) মো. কামরুল হাসান বলেন, আমি বিভিন্ন জলমহালে প্রতিদিন তদারকি করছি। কোথাও সেলু মেশিন দিয়ে জলমহাল শুকিয়ে মৎস্য আহরণ করতে দেখলে সাথে সাথে মেশিন বন্ধ করছি । দীঘা ও বাইম দাইর জলমহাল শুকিয়ে মাছ আহরণ করায় সমিতির বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। যে সমস্ত সমিতি ইজারা আইন ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধেও প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
জেলা মৎস্য অফিসার শামসুল করিম বলেন, মৎস্য কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া আছে উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে যারা বিল শুকিয়ে মাছ ধরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আমি আপনার মাধ্যমে জানলাম জামালগঞ্জে বিল শুকিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সমিতির নিবন্ধনের বৈধ-অবৈধতার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মৎস্যজীবী সমিতি নিয়ন্ত্রণ করে সমবায় অফিস। সমিতির বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিতে পারবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুশফিকীন নূর বলেন, দিরাই-চাতল খননের জন্য অনুমতি নিয়েছে। যে অংশটুকু খননের জন্য অনুমতি নিয়েছে সেইটুকুই শুকাবে। যে সমস্ত বিল শুকিয়ে মাছ ধরা হয়েছে তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত করা হবে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ইজারাদার বিল শুকিয়ে মৎস্য ও জীববৈত্র্যি বিনষ্ট করে ইজারা শর্ত ভঙ্গ করেছে। তাদের লিজ বাতিল করা হবে। কোন অজুহাত দেখিয়ে ইজারাদার বিল শুকিয়ে মাছ ধরার সুযোগ নেই। দিরাই-চাতল বিল শুকানোর প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে কোন অনুমতি দেই নাই।