ইকবাল কাগজী
‘হাওর কেমন আছে?’ এই প্রশ্নটির উত্তরের ভেতরে ‘বাংলাদেশ কেমন আছে’ এই প্রশ্নটির উত্তরও মুখ লুকিয়ে আছে। কারণ বাংলাদেশ নদী-নালা-খাল আর বিল-বাদাড়ের দেশ। বাংলাদেশকে নদীমাতৃক তো বলা হয়েই থকে, সম্পূর্ণ হাওরমাতৃক বলা না গেলেও বিশাল অংশ হাওরের হাওলায় আছে। নদী ছাড়া যেমন বাংলাদেশকে চেনা যায় না, তেমনি হাওর ছাড়া সুনামগঞ্জকে জানা অপূর্ণ থেকে যায়। এখানে হাওর ছাড়া জীবন, আর নুন ছাড়া তরকারি, কেহ কারে নাহি হারে সমানে সমান। হাওর ভালো নেই তো সুনামগঞ্জও ভালো নেই।
একবিংশ শতাব্দির ২০২৫ সনে এসে ‘হাওরের সুরতহাল কেমন’ প্রশ্নটির উত্তরে বলতেই হয় হাওরের হাল বেহালও বেসুরত হয়ে গেছে, যেমন থাকার তেমনটি আর নেই। কেন ভালো নেই? উত্তরের আগে জানা চাই, হাওরে কী কী ও কে কে ছিল আর এখন কী কী ও কে কে আছে। তাদের সকলের একাল সেকালের হদিস জানা চাই। হাওরের শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক আছে তো? এক প্রকার অনুসন্ধানী হয়ে স্বাধীনোত্তর কালের অব্যবহিত পূর্বাপর সময়ের থেকে অদ্যাবধি হাওরবাসীর হালচাল কতোটা বদলেছে অথবা দুর্বিপাকে পড়ে কে কেমন অবস্থায় আছে কিংবা কার কার প্রজাতি বিলুপ্তি ঘটেছে এবং কে কে প্রজাতি বিলুপ্তির বিপদে আছে ইত্যাদি নানাবিধ প্রসঙ্গ নিতান্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
উত্তর সন্ধানের আগে হাওরের ঠিকুজি হাজির করা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হবে না বোধ করি। সে-বয়ার্ণনাটা সামগ্রিক ব্যাপারটাকে বোধাতীত থেকে বোধগম্যতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্রের প্রাচীনত্বকে বৈজ্ঞানিকেরা কমবেশি প্রায় দেড় কোটি বছর আগের বলে নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ হাওরের প্রাগৈতিহাসিক প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কারও মনে কোনও সন্দেহ উদ্রেকের অবকাশ সঙ্গত নয়। মানে হাওর হওয়ার আগে সাগর ছিল। তখন খাসিয়া পাহাড়ের দক্ষিণে কালিদহ নামের সমুদ্র ছাড়া আর কীছুই ছিল না। অন্যূন চার হাজার বছর আগে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজা ভগদত্তের উত্তরসূরির বসতবাড়ির প্রাচীনত্ব স্বীকার করে নিলে বলা যায় কালিদহের উত্তর পাড়ে পাহাড়ঘেঁষা কাছাড়ে জনবসতি ছিল। সেখান থেকেই ক্রমে দক্ষিণের সাগরে জেগে উঠা চরে জনবসতির বিস্তার ঘটেছে। তাই সুদূর প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা বাদ দিন, প্রাগৈতিহাসিক কালের তুলনায় সাম্প্রতিক প্রাচীন কালের কাছাকাছি সময়েও এই হাওরে কোনও জনবসতি ছিল না বলে অনুমিত হয়। এবংবিধ প্রাচীনত্বের বিবেচনায় বলাই যায় যে, অতিসাম্প্রতিক অতীতে এখানে চর জেগে উঠে জনবসতির পত্তন ঘটেছে। নি¤œভূমির এই বসতিওয়ালা অঞ্চলকেই বলা হয় ‘ভাটিবাংলা’ বা ‘ভাটির দেশ’, যাকে হাওরাঞ্চলও বলা হয়। ‘সাগর’ থেকে ‘হাওর’ হয়ে যাওয়া হাওরে নদী, উপনদী, বাঁওর, ডহর, নালা, খাল, বিল, ঝিল, ডোবা, পাগাড়, বাদাড়, প্রান্তর, জাঙ্গাল, কান্দা, বন, জঙ্গল, ঝোপ, ঝাড়, বৃক্ষবাগ স্বভাবতই ছিল এবং তার অবশেষ এখনও কীছু কীছু আছে। যেমন আছে একদা বহতা নদীর চিহ্ন মরা নদী কিংবা মরা গাঙ। এইসব মিলে গড়া জলের রাজ্যে অসখ্য জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদের বাস, তার তালিকা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আগ্রহীরা প্রয়োজনে পাক আমলের সিলেট গেজেটিয়ার্সের শরণাপন্ন হতে পারেন।
এই ভাটিতে কালিদহ নামে এক সমুদ্র ছিল, কিংবদন্তির কথা। মনসামঙ্গলকাব্যের চন্দ্রধরের বাণিজ্যতরির বহর যে সমুদ্রে ভাসতো। সেই ‘সমুদ্র’-এর অনেক প্রতিশব্দের একটি ‘সাগর’।সাগর থেকে সায়র, সায়র থেকে হায়র, হায়র থেকে হাওর হয়েছে। লোকোচ্চারণে সাগর শব্দটি বদলে গেছে। ‘স’ হয়ে গেছে ‘হ’। এই ‘হ’ হওয়ার একটি প্রসিদ্ধ লোকনিরুক্তি আছে। সুনামগঞ্জের উত্তরে ভারতের একটি প্রদেশের নাম আসাম, অধিবাসী আসামীরা (অপরাধী অর্থে ‘আসামি’ নয়) কিন্তু ‘আসাম’কে বলে ‘অহম’, তাদের ভাষার নাম ‘অহমিয়া’। অহমিয়া ভাষায় বাংলাভাষার মতো ‘শ, স, ষ’-বর্ণের ব্যবহার নেই, এইসব বর্ণের বদলে তারা, বলা যায়, বাংলা ‘হ’ বর্ণটিকে ব্যবহার করে। বিজ্ঞ ভাষাবিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করেছেন, অহমিয়া ভাষার প্রভাবে সুনামগঞ্জের ভাষা কীছুটা হলেও প্রভাবিত হয়েছে। ফলে সুনামগঞ্জের লোকেরা ‘সাপ, শাপলা, শালুক, সানকি, সন্ধ্যা, সাজ, সমান, সকল, সাতকরা, সঙ্গি, সঙ্গে, শেয়াল, শালা’ ইত্যাদি অগুন্তি শব্দকে যথাক্রমে হাফ, হাপলা, হালুক, হানকি, হাঞ্জা, হাজ, হমান, হকল, হাতকরা, হঙ্গি, হঙ্গে, হিয়াল, হালা উচ্চরণ করে থকেন। ‘সাগর’ শব্দটিও এবংবিধ লোকনিরুক্তির গুণে ‘হাওর’ হয়ে গেছে। বৃহত্তর সিলেটসহ ময়মনসিংহ ও তার সন্নিহিত অঞ্চলের ভাষায় অল্পবিস্তর এই ব্যুৎপত্তি নির্দেশের প্রভাব বিদ্যমান।
পৃথিবীতে যে-কোনও ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশের বাসিন্দারা হলো কমবেশি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল। হাওর তার ব্যতিক্রম নয়, এখানে জীবজগতের প্রধান হলেন অপরিণামদর্শী মানুষ, ভাটির বাঙাল। এই বাঙালের কেউ কেউ বুকে বসে মুখে মারতে কসুর করে না। প্রাণীকূলের মধ্যে বড়বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের বংশধর হিসেব ভাটির বাঙালদের এই ‘কেউ কেউ’ ভীষণ ভীষণ খতরনাক। তাঁরা নিজের পেটপূজায় নিমগ্ন হয়ে হাওরের সমগ্র প্রাণপ্রকৃতিকে ক্রমাগত গলাধঃকরণ করে চলে প্রকারান্তরে নিজের প্রজাতির বিলুপ্তির প্রাকৃতিক পরিসর তৈরি করে এবং করছে। মহাকবি কালিদাস নাকি গাছের যে-ডাল কাটবেন সে-ডালের আগার দিকে বসে গোড়ার দিকে কাটতে লেগেছিলেন। বোকামি আর কাকে বলে। হাওরেও মানুষ প্রকৃতিকে মারতে বসেছে, যে-প্রকৃতি প্রতিনিয়ত তার খাওয়া, পরা ও থাকার সংস্থান করে চলেছে।
ইদানিং হাওর বেহাল দশায় আছে, বললেই তো হবে না, তার প্রমাণ চাই। অনেক অনেক প্রমাণ আছে। সেসব প্রমাণের একটি হাজির করাই যথেষ্ট। গত মঙ্গলবার ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখের দৈনিক সুনামকণ্ঠ দেখুন। একটি সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে, ‘দেখার হাওরের বড়দৈ কাষ্ঠগঙ্গা বিল শুকিয়ে মাছ শিকার’। সংবাদবিবরণীতে পাবেন,“সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের দেখার হাওর অংশের বড়দৈ কাষ্ঠগঙ্গা বিল শুকিয়ে মাছ শিকার করছেন সাব ইজারাদার আতাউর রহমান গং। এতে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় মাছের বংশ। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিল শুকিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে স্মারক নম্বর ০৫.৪৬.৯০০০.০০৮.১২.০১৭.২৩- ১৩২২ (৬) আলোকে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ১৩/০৩/২০২৩ তারিখের ৩১.০০.০০০০.০৫০.৬৮.০০৫.২৩.২১০ নম্বর স্মারক সূত্রের প্রেক্ষিতে শান্তিগঞ্জ উপজেলা, সদর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত বড়দৈ কাষ্ঠগঙ্গা জলমহালটি ০৬/০৩/২০২৩ খ্রি. তারিখে ইজারা পান শান্তিগঞ্জ উপজেলার আসামপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ইনাতনগর আসামপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালিক। তিনি ১৪৩০ বাংলা সনের জন্য বিল ইজারা পান। পরে এই বিল সাব ইজারা আনেন পৌর এলাকার সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্দুর রহীমের পুত্র আতাউর রহমানসহ আরও ৪/৫ জন। বর্তমানে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে এই বিল শুকিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, বড়দৈ কাষ্ঠগঙ্গা বিলের আশপাশের খাগোড়া গ্রাম, মোল্লাপাড়া, সরইবন্দ গ্রাম, জায়ফরপুর, মৌকলা, মনোহরপুর, ভল্লবপুর গ্রাম, রামেশ্বরপুর, ফতেহপুর, লালপুর, পলিচর, মঙ্গলপুর গ্রাম, করিমপুর, সোনাপুর, নতুননগর গ্রামের আশপাশের সকল ডোবা-নালা শুকিয়ে মাছ শিকার করে আসছেন সাব ইজারাদার আতাউর রহমান। কৃষকেরা জানান, অসময়ে বিল শুকিয়ে মাছ শিকার করার কারণে কৃষি কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। বিল শুকিয়ে মাছ ধরায় আশপাশ এলাকার প্রায় দেড় হাজার একর জমির কৃষক পানি সংকটে ভুগছেন। তারা জমিতে পানি দিতে পারছেন না। পৌষ মাসে লাগানো ধান গাছের চারা এখন প্রায় স্থানে নেতিয়ে পড়ছে। একাধিক কৃষক জানান, মাঘ মাসে ধান গাছে বেশি পরিমাণে পানি দিতে হয়। কিন্তু এই সময়ে পানি সংকটে ভুগছেন তারা।”
উপরিউক্ত বিবরণ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বলা যায়, মানুষ বিলের শত্রু হয়ে পড়েছে। বিলের শত্রু মানে হাওরের ও হাওরের প্রাণবৈচিত্রের শত্রু হওয়া। হাওরের শত্রু মানুষ মানেই অন্য মানুষের শত্রু। এখানে ইজারাদার হাওরের শত্রু হয়ে প্রাণপ্রকৃতিসহ মানুষের শত্রু হয়ে উঠেছে এবং ইজারাদারের সঙ্গে যুক্ত আছে প্রশাসন। কারণ প্রশাসন ইজারাদারকে বিল ইজারা দিয়ে অপরিণামদর্শিতার পরাকাষ্ঠা প্রকাশ করেছে। প্রশাসন মানে সরকার। সরকার চলে পুঁজির প্রভুত্ব মেনে, সন্দেহ নেই, পুঁজিবাদতাই প্রকৃতি কিংবা প্রাণপ্রকৃতি ও মানুষের শত্রু।
মানুষ মাছ-গাছ বা প্রকৃতির প্রাণবৈচিত্রের সংশ্রব ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। কারণ নিজে প্রকৃতির অংশ হিসেবে প্রকৃতির সঙ্গে উৎপাদনের কাজে না জড়িয়ে তার বাঁচা হয় না। মানুষ প্র্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে বদলে দিয়েই কেবলপ্রকৃতির কোলে বেঁচে থাকার উপযুক্ততা অর্জন করে এবং প্রকৃতিকে বা প্রকৃতির নিয়মকে মানুষ যতোটা জানতে পারে ততোটাই সে বৈজ্ঞানিক এবং যতোটা সে বৈজ্ঞানিক তার জীবনকে ততোটাই সে সহজ, সুন্দর ও উন্নত করতে পারে। এক অর্থে প্রকৃতিকে জানা ও প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করাই মানুষের জীবনের টিকে থাকার ও জীবনমান উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।
এতোসব কথা এই জন্যে বলা যে, নিজের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মানুষকে এইসব জানতে হবে এবং মানতে হবে। তথাপিও সরকারের কাছ থেকে বিল ইজারা নিয়ে বিল শুকিয়ে মাছ শিকারি ইজারাদার প্রশাসনের গাফিলতিতে রেহাই পেয়ে গিয়ে দায়মুক্তি অর্জন করে। প্রকারান্তরে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যক্তিগত সম্পদের বহর বাড়ায় এবং মানুষে মানুষে আর্থনীতিক বৈষম্য বাড়ে, তৈরি হয় শ্রেণিঘৃণা।
জলমহাল ইজারা দেওয়ার আইনে আছে বিল শুকিয়ে মাছ ধরা যাবে না, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ এই অপরাধটি প্রতি বছর করে থাকে ইজারাদার, প্রশাসন কোনও প্রতিরোধ তোলে না, এমনকি অভিযোগ উপেক্ষা করে। প্রতিবছর বিল শুকিয়ে মাছ ধরার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, কিন্তু চিহ্নিত এই অপরাধীদের শাস্তি হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নাকে তেল দিয়ে নিদ্রাতুর থাকেন। খবরওয়ালার ক্যামেরা বড়দৈই বিল শুকিয়ে মাছ মারার দৃশ্য দেখে; প্রশাসন দেখে না, চোখ বুজে থাকে। সচিত্র সংবাদ ছাপা হয়। ‘প্রেমের মানুষ ঘুমাইলে চাইয়া থাকে’, কিন্তু প্রশাসন প্রেমের মানুষ নয়, তাকে অবশ্যই জেগে থাকতে হবে. চোখ মেলে দেখতে হবে; সকল প্রকার দুর্নীতি, অনিয়ম ও অসঙ্গতির প্রতিকার করতে হবে, আইন লঙ্ঘনকারীকে দ- দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই না হবে প্রশাসন, অন্যথায় প্রশাসন কীসের! এই কথাটা প্রশাসনের আসনে উপবিষ্টরা কীছুতেই বুঝতে চান না। কেন না তাঁরা আসলে সা¤্রাজ্যবাদী টমাস ব্যাবিংটন মেকলের চেলা। তাঁরা সরকারি পরিসরে থেকে বেসরকারি পরিসরের প্রভু হয়ে উঠেন এবং প্রকারান্তরে বেসরকারি পরিসরের নিপীড়িত মানুষজনের অভিযোগ উপেক্ষা করে ইজারাদারের স্বার্থ সংরক্ষণব্রতী হয়ে উঠতে পছন্দ করেন। হাওরাঞ্চলে জলমহাল ও বালিপাথর মহালগুলোতে ইজারাদারি প্রথার বদৌলতে আইনের অপব্যবহারের সংস্কৃতি প্রতিপন্ন করে যে, শ্রেণিস্বার্থ চরিতার্থ করতে ইজারাদারের সঙ্গে প্রশাসনের একটি মোর্চা গঠিত হয়। অর্থাৎ দেশে নয়া ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক বিন্যাসকাঠামোর পরিসরে অধিপতি শ্রেণির আধিপত্য উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনে সমস্বার্থের সামাজিক শক্তিসমূহের মোর্চা গঠনের রাজনীতির সক্রিয় আছে, প্রতিপন্ন হয়।
এই প্রেক্ষিতে সমগ্র হাওরাঞ্চলে বিল শুকিয়ে মাছ মারার মতো প্রাণপ্রকৃতি বিনাশী অন্যান্য অনেক অবিমৃষ্যকর কা- বছরের পর বছর ঘটেই চলেছে এবং চলবে। হাওরের ফসলের ক্ষেতে জীববৈচিত্রবিনাশী কীটনাশক ও জালের ব্যবহার, প্লাস্টিক বর্জ্যপ্রক্ষেপণ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি অপকর্ম প্রকারান্তরে মাছসহ সমগ্র জলজীবপ্রজাতিকে বিলুপ্তির শিকারে পর্যবসিত করেছে। এই কারণে ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চলকে ‘জলের মরুভূমি’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজাতি উত্তরোত্তর বিলুপ্তির বিরূপ প্রভাব পড়ছে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উপর। মানুষ আগেকার মতো সহজে কেবল মাছ থেকে নয়, শরীরে গ্রহণযোগ্য সকল প্রকার জলপ্রাণপ্রকৃতির উপাদান থেকে প্রাপ্ত খাদ্যপ্রাণ ও অন্যান্য ব্যবহারিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যে মানুষ সুস্থ দেহগঠন ও স্বাস্থ্যপ্রাপ্তির উৎকর্ষতার দিক থেকে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখিন হতে শুরু করেছে, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। এইভাবে চলতে থাকলে প্রকারান্তরে শারীরিক পর্যায়ে বামনত্ব ও জড়ধী হয়ে পড়ে শারীরিক সামর্থ্য ও মেধানির্ভর আগামী উন্নত পৃথিবীতে টিকে থাকার যোগ্যতা হারাবে এ অঞ্চলের মানুষ। এই একবিংশ শতাব্দির শুরুর দশক তিনেকের মধ্যে যদি প্রাকৃতিক সমৃদ্ধিকে ফিরিয়ে এনে প্রকৃতিকে মানববান্ধব করা না যায় তবে সমূহ বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষায় থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিল শুকিয়ে মাছ মারা মামুলি কোনও বিষয় নয়, মানবপ্রজাতির সদস্য হিসেবে বিলকে ও বিলের প্রাণপ্রকৃতিকে রক্ষা করার অর্থ হলো এ অঞ্চলের মানবপ্রজাতিকে রক্ষা করা এবং তার বিপরীত কাজ করার অর্থ হলো মানবপ্রজাতিকে খুন করা। তাই বিল খুন আর পরিণতিতে মানুষ খুন একই কথা। যারা বিলকে হত্যা করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে নিরস্ত করতে হবে, প্রকৃতির হাতে মানুষ খুন হওয়ার বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে, ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার ইতিহাস লেখার কেউ থাকবে না।