আকরাম উদ্দিন
সুনামগঞ্জের দানবীর ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. নূরুল হক মহাজনের ইন্তেকালে শোকার্ত হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। বুধবার (৮ জানুয়ারি) দুপুরে যখন শহরে মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছে, তখন আফসোসে ও শোকে মুহ্যমান হয়েছেন শহরের ব্যবসায়ী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষজন। এ যেন এক নিজের আপনজনের প্রয়াণ।
মরহুম নূরুল হক মহাজনের জন্য মানুষের এতো আবেগ ও ভালবাসা দেখে তখন আমার মনে হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত কবিতার দু'টি লাইন- ‘এমন জীবন তুমি করিও গঠন, / মরিলে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।”
বুধবার রাতে মরদেহের পাশে উপস্থিত মানুষের আক্ষেপ ও আহাজারি দেখে মনে মনে ভেবেছি, আজ মানুষের হৃদয়ের গহীনে এমনটিই ধারণ করতে পেরেছেন সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সালিশ ব্যক্তিত্ব এবং গরীব ও দুখি মানুষের আশ্রয় শ্রদ্ধেয় নূরুল হক মহাজন।
৮ জানুয়ারি ২০২৫ খ্রি. বুধবার দুপুর দেড় টায় সিলেট মাউন্ট এডোরা হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সালিশ ব্যক্তিত্ব মো. নূরুল হক (৮৪) ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
ওইদিন বিকেল থেকে শহরের তার হাজীপাড়াস্থ বাসভবনে দলে দলে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের ঢল নামে। মহাজন সাহেবের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া মানুষগুলো কান্না বিজড়িত কণ্ঠে নানা স্মৃতিচারণ করেন। তারা যেন হারিয়ে ফেলেছেন তাদের আপনজন, তাদের একজন অভিভাবক।
মহাজন সাহেবের কাছে গরিব-দুখি মানুষ শান্তি খুঁজে পেতো। তিনি তাদের আশ্রয় এবং ভরসার স্থল ছিলেন। মানুষকে অন্তরে আগলে রাখার এমন গুণই ছিল নূরুল হক মহাজন সাহেবের। সাধারণ মানুষ মহাজন সাহেবের খোশগল্পের জড়ো হতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যেন নিমিষে কেটে যেত। সবাইকে ভালোবাসার মহৎ এক গুণ ছিল তাঁর মাঝে।
ধর্ম পরায়ণ মানুষ মহাজন সাহেব ছিলেন দানশীল। নীরবে দান করতেন দু’হাত ভরে। এ জন্য জেলাজুড়ে দানবীর নামে তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মানুষকে বাসস্থান, বিপদগ্রস্ত মানুষকে আর্থিক সাহায্য করতেন। অনেক মানুষকে নানাভাবে উপকার করতেন। কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেননি। যে কারণে সকল মানুষের কাছে তিনি বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
সেই অন্তত ৫০ বছর আগে থেকে বিচার-সালিশের মাধ্যমে কত সহ¯্র মানুষকে তিনি সামাজিক ও আত্মীয়ের সম্পর্ক রক্ষায়, তাদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এবং মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা থেকে রক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আজ এমন স্মৃতিচারণ হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে।
শ্রদ্ধেয় নূরুল হক মহাজন সাহেব। তিনি আমারও মুরব্বী। সেই ১৯৯০ সাল উনার সাথে আমার পরিচয়। মহাজন সাহেবের গভীর ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল বিশিষ্ট ব্যবসায়ী টেলিকম ওয়ার্ল্ডের মালিক মরহুম হাজী সৈয়দুর রহমান ভাইয়ের সাথে। তিনি আমার চাচাতো ভাই। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন- সে আমার ছোট ভাই। এই থেকে তিনি আমার নানা ভাই। চলাফেরায় যখন কথা হতো তখন তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন। খুবই ভাল লাগতো নানা ভাইয়ের হাসিমাখা মুখ।
সৈয়দুর ভাইয়ের সাথে প্রায় সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে, মার্কেটের পিছনে মহাজন সাহেবের অফিসে যেতাম। ঘনিষ্ঠতার কারণে তিনি একবার রঙ্গারচর ইউনিয়নে পাঠালেন। সেখানকার দুই পক্ষের জমি সংক্রান্ত ঝামেলা নিষ্পত্তি করেছেন তার অফিসে বসে। শুধু জমি পরিমাপ করে দিতে আমাকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। আমার যেতে ইতস্ততা দেখে তিনি বললেন- পরিমাপে যেখানে আসবে সেখানেই খুঁটি দিবে। মনে করো তুমিই আমি। এটা আমার নির্দেশ। উপস্থিত উভয়পক্ষ হ্যাঁ বলার পর আমি সেখানে গিয়ে সীমানা নির্ধারণ করে দিয়ে আসি।
বুধবার শহরে পৌঁছতেই একজন বলে উঠলেন- বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নূরুল মহাজন সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। আমি ইন্নালিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন বললাম। অর্থাৎ ‘আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ফিরে যাবো’। এই আয়াত পড়ে পড়ে ধীরে ধীরে হাজীপাড়া এলাকায় তাঁর বাসভবনের দিকে চলে গেলাম। শেষবারের মতো তাঁকে একনজর দেখলাম। প্রাণখুলে দোয়া করলাম- হে আল্লাহ, তোমার বান্দাকে জান্নাত দান করুন।
[আকরাম উদ্দিন : সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক সুনামকণ্ঠ]