বিশেষ প্রতিনিধি ::
জামালগঞ্জের কৃষকের দুঃখের আরেক নাম হাওরের জলাবদ্ধতা। বিগত সময়ে কোটি কোটি টাকার দায়সারা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু হাওরের জলজট নিরসন করে দুঃখ গোছানো সম্ভব হয়নি কৃষকের। উপরন্তু খননের নাম করে বরাদ্দের বেশির ভাগ অর্থ লোপাট হয়েছে। যেখানে বরাদ্দ নয়ছয়ের সুযোগ কম, সেখানে জলাবদ্ধতা থাকা সত্বেও প্রকল্প কিংবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সদিচ্ছা ছিল না সাবেক জনপ্রতিনিধিসহ (স্থানীয় সংসদ সদস্য) পাউবো কর্তৃপক্ষের। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে কৃষকের।
বিগত বছরগুলোতে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতা এবং অনিয়ম-লুটপাটের কারণে চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলার ছোট-বড় সাতটি হাওরের প্রায় দশ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। চর জাগা স্থান শুকিয়ে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হওয়ায় চাষাবাদ নিয়ে বাড়তি চিন্তায় পড়েছেন কৃষক। দায়সারা খনন ও পানি নামার পয়েন্টগুলোতে নজর না দেওয়ায় একাধিক হাওরের বেশকয়টি অংশের পানি সরছে না।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জামালগঞ্জের ছোট-বড় সাতটি হাওরের প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ২৫ হাজার ৩৪২ জন কৃষক বোরো আবাদ করছেন। চলতি রবি মৌসুমে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ দুই হাজার ৪৮৯ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে হাইব্রিড ৪১ হাজার ৮৬২ মেট্রিক টন, উফসী ৬০ হাজার ৫৯৯ মেট্রিক টন এবং স্থানীয় জাতের ২৯ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হবে। যার বাজার মূল্য ৪৭১ কোটি ৪৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। জলাবদ্ধতার কারণে চাষাবাদ ব্যাহত হলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ না হওয়ার শঙ্কা কৃষকের।
ফসল ফলানোর জন্য কৃষক নিজ খরচে কোন কোন বাঁধ কিংবা নালা কেটে পানি নিষ্কাশনের পথ তৈরি করেছে। হাওরভর্তি পানির তুলনায় নিষ্কাশিত পথ ছোট হওয়ায় সময়মতো কৃষিজমি প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া হাওরের কিছু কিছু জায়গা পানিতে তলিয়ে থাকার কারণে চাষাবাদের হাল ছেড়েই দিয়েছে কৃষক। উপজেলার বোরো আবাদের ভা-ারখ্যাত হালি ও পাগনা হাওরের বেশকিছু জায়গা ঘুরে এ রকম উদ্বেগজনক চিত্র চোখে পড়েছে।
সম্প্রতি পাগনা ও হালি হাওরের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, অপরিকল্পিত খনন ও পানি চলাচলের উৎসস্থল শুকিয়ে যাওয়াসহ নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকায় হাওরের অনেক জায়গা এখনও ডুবন্ত অবস্থায় আছে। পাগনা হাওরের জলাবদ্ধতা রোধে শান্তিপুর-সেলিমগঞ্জ বাজার ও ভূতিয়ারপুর অংশে যে খনন হয়েছে তাতে তেমন উপকৃত হয়নি কৃষক। নামমাত্র খননের পর তীরে ফেলা মাটি খননকৃত স্থানে গিয়ে পড়েছে। তাই খনন হওয়া স্থান ফের ভরাট হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে।
এদিকে, পাগনা হাওরের ক্ষত সৃষ্টিকারী কানাইখালী নদীর এ ধারা দিয়ে পানি ঠিকঠাকভাবে নামতে পারছে না। এছাড়া গত বছর উপজেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে গজারিয়া স্লুইচ গেট অংশে খনন করা হয়েছিল। পানি চলাচলের সাময়িক পথ করা হলেও এ বছর সে অংশ ফের ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।
গজারিয়া স্লুইচ গেট অংশে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার পানি নামার ধারাটি যেন শুকনো খাল। গজারিয়া নদীর দুই তীর ভরাট হয়ে পানি আসা-যাওয়ার বদলে পায়ে হাঁটার উপযোগী হয়ে পড়েছে। মাঝের নালাসদৃশ্য চিকন ধারা দিয়ে পানি চলাচল করতে পারছে না।
কৃষকের নির্বিঘœ চাষাবাদ এবং ফসল তোলা পরবর্তী পানি চলাচলের সুবিধার্থে গজারিয়া গ্রামের সুরমা নদীসংলগ্ন অংশে স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু পাগনা হাওরের কানাইখালি পর্যন্ত বিস্তৃত এক সময়ের গজারিয়া নদী বর্তমানে পলি পড়ে বিপন্ন অবস্থায় আছে। এছাড়া পাগনা হাওরের পানি নিষ্কাশনের আরেক পথ ডালিয়া স্লুইচ গেটও সে রকম পানি টানতে পারছে না। পিয়াইন নদীর পানি নামার সেই উৎসস্থলে নির্মিত এ স্লুইচ গেট অনেকটা ভরাট ও খননহীনতার ব্যথায় ধুকছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে, তিন উপজেলা (জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও ধর্মপাশা) নিয়ে বিস্তৃত হালি হাওরের মামুদপুর থেকে আছানপুর পর্যন্ত হেড়াকান্দি ও কেছইড়া বিল অংশের বিশাল জমি এখনও জলমগ্ন। হাওরের নিমজ্জিত এ অংশে বর্ষাকালের আবহ ফুটে উঠেছে। কৃষক নিজেদের খরচে মামুদপুর ও হেড়াকান্দি অংশের বাঁধ কেটে পানি নিষ্কাশনের পথ করেছে। তবে পানি নামার সরু পথ ও গতি দেখে যথাসময়ে এ বিশালাকার জমি চাষাবাদের উপযোগী হবে বলে মনে হয়নি। বরাদ্দ লুটপাট ও পাউবোর খামখেয়ালিপনায় কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
হালি হাওর পাড়ের মদনাকান্দি গ্রামের কৃষক দেবাশীষ তালুকদার বলেন, মামুদপুর থাইক্যা (থেকে) দুর্গাপুর-মদনাকান্দি হইয়া (হয়ে) হেড়াকান্দি পর্যন্ত যে জায়গাডা আছে, এইখানে সব বছরই পানি জইম্যা থাকে। মামুদপুর ও হেড়াকান্দি দুইখানে বাঁধ কাইট্যা দেওয়া হইছে। ধীরে ধীরে পানি নামার পরে জমিন রুয়ার উপযুক্ত হইবো।
স্লুইচ গেটের দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, থালের মতো এই জায়গাডাতে ৫শ’ হেক্টরের বেশি জমি আছে। কৃষক প্রায় হাজারখানেক। সব মিলাইয়া গিরস্থরা ভালা নাই। স্লুইচ গেট দিয়া পানি চলাচলের ব্যবস্থা করলে সময়মতো বোরো ধান লাগানি যাইব।
হাওরের জলাবদ্ধতা ও খনন সংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাগনা হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক ভূতিয়ারপুর খাল পুনঃখনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ফেনারবাঁক ইউনিয়নের শান্তিপুর গুদারাঘাট হতে সেলিমগঞ্জ বাজার হয়ে ভূতিয়ারপুর পর্যন্ত ছয় দশমিক ৩৫০ কিলোমিটার প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ৩ কোটি ২১ লাখ ১১ হাজার ৩৭৬ টাকা।
২০২৩ সালের শুরুতে খনন চলাকালীন ভূতিয়ারপুর অংশ দেখতে গিয়ে খনন কাজের গতিপ্রকৃতি এ প্রতিবেদকের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি। ভেকু মেশিন দিয়ে খালের মাঝ অংশে কোনরকম খননের রেখা টেনে, খননকৃত মাটি দুই পারে রেখে খাল ফের ভরাটের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। এতে জলাবদ্ধতা রোধে কৃষকের কতটুকু উপকার হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাওর পারের এক কৃষক জানিয়েছেন, ভূতিয়ারপুর খাল খননের কাজ হয়েছে তিনভাগের এক ভাগ। ভেকু মেশিন দিয়ে খালের পাড় চেঁছেপুছে, মাঝের একটু মাটি তুলে কাজের বিষয়টা বোঝানো হয়েছে। গঙ্গাধরপুর-ছয়হারা নদী খনন ছাড়াও অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। মূলত এগুলো কানাইখালি নদী দেখিয়েই আনা হয়েছে। এসব কাজে হাওর কিংবা কৃষকের তেমন উপকার হয়নি। সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জলাবদ্ধতা রোধে সেলিমগঞ্জ-ভূতিয়ারপুর খাল খনন কাজে কৃষকের ‘টেন পার্সেন্ট’ উপকার হয়েছে জানিয়ে ফেনারবাঁক ইউপি চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার বলেন, বর্তমানে গজারিয়া ও ডালিয়া স্লুইচ গেটের মুখ খনন করা হচ্ছে। সপ্তাহখানেক পানি নামলেই জলাবদ্ধতা দূর হবে। তবে এ কাজ ক্ষণস্থায়ী, কেবল বিপদকালীন সময়ের জন্য করা হয়েছে। বিগত সময়ে খনন কাজে লুটপাটের বিপরীতে উপকার হয়েছে দশ ভাগ। নব্বই ভাগই অপকার হয়েছে কৃষকের।
তিনি আরও বলেন, গত বছর ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে গজারিয়া স্লুইচ গেট থেকে পাগনা বিলের মুখ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার খনন হয়েছিল। এ বছরও স্থানীয় কৃষক ও বিলের লোকজনের সহযোগিতায় পানি নামার কিছু পথ খনন হয়েছে। তবে তা অপরিকল্পিত। যাচাই বাছাই করে সম্পূর্ণ পরিকল্পনামাফিক খননের ব্যবস্থা করতে পারলে পাগনা হাওর পাড়ের পাঁচ ইউনিয়নের হাজার দশেক বোরো চাষী উপকৃত হবে।
ভীমখালী ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, জলাবদ্ধতায় প্রতি বছর পাগনা হাওরের ভীমখালী অংশের দশ-বারোটি গ্রামের প্রায় সাত হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হয়। প্রতি বছর গৃহস্থরা সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সেচ করে তারপর বোরো চাষাবাদ করেন। এ বছরও এমনটি করা হচ্ছে।
এ সমস্যা দীর্ঘদিনের জানিয়ে তিনি আরও বলেন, মল্লিকপুরের ভাইট্টলের খাড়ার পানি লক্ষ্মীপুর ও বিনাজুরা ব্রিজের নীচ দিয়ে ডালিয়া স্লুইচ গেট হয়ে নদীতে পড়ে। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের এ রাস্তাগুলো ভরাট হওয়ার ফলে অনেক কৃষক তাদের জমিজমা থাকা সত্বেও চাষাবাদ করতে পারছেন না। তাতে কয়েক হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের সুনির্দিষ্ট পয়েন্টগুলো জরুরী ভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, হ্যাঁ, পাগনা হাওরের ভূতিয়ারপুর অংশে একটা খাল খনন করা হয়েছিল। এখানে শতভাগ কাজ হয়নি। প্রায় পঁয়ষট্টি ভাগ কাজ হয়েছে। তবে শতভাগ কাজ হলে কৃষক আরও বেশি উপকৃত হতো। এখানে বাড়ি-ঘর সংক্রান্ত জটিলতার কারণে হানড্রেট পার্সেন্ট কাজ করা সম্ভব হয়নি। কাজ যতটুকু হয়েছে ততটুকুই বিল দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর উপজেলার বরাদ্দ থেকে সাময়িক পানি নিষ্কাশনের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আসলে হাওরের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। জাইকা প্রকল্পের আওতায় হালি হাওরের মামুদপুর ও হাড়াকান্দি অংশটুকু ধরা আছে। পর্যায়ক্রমে এগুলোতে স্লুইচ গেট করা হবে।