সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সেই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গত সেপ্টেম্বরে যাত্রা করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। বর্তমানে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য কাজ করছে সংগঠনটি। সেই লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে সংগঠনকে সুসংহত করছে তারা। ইতিমধ্যে দেশের প্রায় ১৩০টি থানা ও উপজেলায় প্রতিনিধি কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্য দিয়ে আগামী দুই মাসের মধ্যেই নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম এই শক্তি।
আত্মপ্রকাশের শুরু থেকেই তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। দেশ পুনর্গঠনে তারুণ্যনির্ভর রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া হিসেবে তরুণ নেতৃত্বের সমন্বয়ে কমিটিগুলো করা হচ্ছে। প্রতিনিধি কমিটির সদস্যদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও ঢাকার মধ্যে সেটি ৪৫ বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা গেছে। এসব কমিটিতে শিক্ষক, আইনজীবী, লেখক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা যুক্ত হচ্ছেন।
তবে জাতীয় নাগরিক কমিটি চমক দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এ কমিটিতে দেশের জনপ্রিয় তরুণ ও ছাত্রনেতারা যুক্ত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক নেতা, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের শীর্ষপর্যায়ের নেতা, অ্যাকটিভিস্ট, চিন্তক, চিকিৎসা, আইন, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন সেক্টরে বর্তমানে যেসব তরুণ জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, তাদের সম্মিলন ঘটছে।
কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাবেক ডাকসু নেতাদের মধ্যে আছেন সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, যিনি নাগরিক কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন, শামসুন নাহার হলের সাবেক ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি, কবি সুফিয়া কামাল হল ছাত্র সংসদের জিএস মুনিরা শারমিন, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল সংসদে জিএস সাগুফতা বুশরা মিশমা, নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সারজিস আলমও অমর একুশে হল সংসদের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচন করা অরণি সেমন্তি খান, উম্মে হাবিবা বেনজির, দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী, সৈয়দা নীলিমা দোলা আলোচিত ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন।
সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে আছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অনিক রায়, ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম আদীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি আলী আহসান জুনায়েদ, রাফে সালমান রিফাত, ঢাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সাধারণ স¤পাদক আকরাম হুসাইন, ঢাবি ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি আবু রায়হান খান।
এছাড়া তরুণ জনপ্রিয় আইনজীবীদের মধ্যে নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হয়েছেন অ্যাডভোকেট মানজুর আল মতিন, অ্যাডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান মুকুল, অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম মুসা, অ্যাডভোকেট আলী নাছের খান, মনজিলা ঝুমা, হুমায়রা নূর ও সাকিল আহমাদ। সাংবাদিকদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক নেতা মীর আরশাদুল হক, আরিফুর রহমান তুহিন, প্লাবন তারিক ও জয়নাল আবেদীন শিশির।
এ ছাড়া কমিটির সদস্যদের মধ্যে আছেন মায়ের ডাকের সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি, চিকিৎসক তাসনীম জারা, চিকিৎসক ও অ্যাকটিভিস্ট তাজনূভা জাবীন, ডা. মাহমুদা মিতু, বাংলাদেশে মেটার পাবলিক পলিসি প্রধান সাবহানাজ রশীদ দিয়া, গবেষক ও লেখক সারোয়ার তুষার, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাবেক সদস্য প্রীতম দাশ, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি, অ্যাকটিভিস্টদের মধ্যে মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান, সালেহ উদ্দিন সিফাত, আরেফীন মোহাম্মদ ও নাহিদা সারোয়ার নিভা অন্যতম।
তরুণ বুদ্ধিজীবী চিন্তক হিসেবে আছেন দেবাশীষ চক্রবর্তী, মোহাম্মদ এজাজ, মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া, এহতেশাম হকসহ অনেকে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া মশিউর রহমান, মোহাম্মদ আতাউল্লাহসহ কয়েকজন আছেন এই কমিটিতে। জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দলিত হরিজন তফসিলি প্রতিনিধি হিসেবে আছেন কৈলাশ চন্দ্র রবিদাস ও ভীস্পাল্লী ডেভিড।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারুণ্যের অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক চর্চা এবং পলিসি মেকিংয়ে তরুণদের সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগের কারণেই জাতীয় নাগরিক কমিটিতে তরুণ নেতৃত্বের সম্মিলন ঘটছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হওয়া এসব তরুণ প্রতিনিধিরাই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও আগামীতে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন বলেই বিশ্বাস তাদের।
জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব ও ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি রাফে সালমান রিফাত বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২৪-এর ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া একটা সম্ভাবনার নাম। আমরা যে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি, তার বাস্তব সম্মিলন ও প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই নাগরিক কমিটিতে। এখানে বিভিন্ন মত-পথের, ধর্ম-বর্ণের, রাজনৈতিক আদর্শের তরুণদের এক অভূতপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে। এই তরুণরাই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও শক্তিশালী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাতা হবে ইনশাআল্লাহ।
কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য মোল্লা মোহাম্মদ ফারুক এহসান বলেন, বাংলাদেশের ৪০ ভাগ ভোটারের বয়স ৩৫-এর কম। এই ৪০ ভাগ ভোটারের এটি প্রথম ভোট, কারণ গত ১৬ বছর বাংলাদেশে কোনো ভোট হয়নি। এই ৪০ ভাগ তরুণ ভোটারের মননকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ধারণ করতে পেরেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তারুণ্যের অংশগ্রহণ এবং পলিসি মেকিংয়ে তরুণদের স¤পৃক্ত হওয়ার সুযোগের কারণেই জাতীয় নাগরিক কমিটি আমাকেসহ ধীরে ধীরে সব তরুণকে আকর্ষণ করছে।
আরেক কেন্দ্রীয় সদস্য শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, জাতীয় নাগরিক কমিটি বিভিন্ন সেক্টরের তরুণদের এক প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করছে, যেটার প্রক্রিয়া এখনো চলমান। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী তরুণদের একসঙ্গে করার এই প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে সাবেক এবং বর্তমান ছাত্রনেতা, ডাকসুর সাবেক নেতাদের, উচ্চশিক্ষারত প্রবাসী, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষসহ মাঠপর্যায়ের সংগঠকরা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন মতের এবং বিভিন্ন পথের মানুষের এই সম্মিলনকে আরও সমৃদ্ধ করে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে প্রতিষ্ঠা করতে জাতীয় নাগরিক কমিটি দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এদিকে সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তৃতির অংশ হিসেবে গত দেড় মাসে দেশের ১৩০ থানা ও উপজেলায় ‘প্রতিনিধি কমিটি’ গঠন করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে দেশের থানা ও উপজেলা পর্যায়ে এখন কমিটি করছে তারা। এ পর্যন্ত সব কমিটি মিলিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজারের বেশি। গত ৮ নভেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ৬১ সদস্যের প্রতিনিধি কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সাংগঠনিক বিস্তৃতি শুরু হয়। দেশের সব থানায় প্রতিনিধি কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে আগামী দুই মাসের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে চায় তারা।
জাতীয় নাগরিক কমিটির পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও ঢাকার বাইরে কমিটি করছে। এখন পর্যন্ত দেশের ১৮টি জেলা, তিনটি মহানগর, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ গাইবান্ধায় ২৩৮ সদস্যের কমিটি করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বিভিন্ন জেলায় সফরও করছেন গণ-অভ্যুত্থানের এই দুই শক্তি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, আমাদের ১০০-এর অধিক কমিটি গঠিত হয়েছে। চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তৃতির কার্যক্রম সমাপ্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। শিগগিরই সাংগঠনিক সফর শুরু করব আমরা। প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমরা যখন পৌঁছে যাব, তখনই নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হব।
তরুণ নেতৃত্বের সম্মিলনের বিষয়ে মুখপাত্র বলেন, আমরা তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাচ্ছি। নানা শ্রেণির তরুণরা আমাদের দেশে আছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে সিগনিফিকেন্ট ভাগ আছে কিন্তু তরুণদের মধ্যে এটা অনেক বেশি ডাইভার্স এবং অনেক ধরনের চিন্তার সম্মিলন ঘটে। কেননা একুশ শতাব্দীতে তরুণদের মধ্যে নানা ধরনের চিন্তার মিশেল ঘটে, নতুন নতুন রাষ্ট্র ভাবনার মিশেল ঘটে। তরুণদের একধরনের জ্ঞানের উন্মেষ আছে। এই নানা ধরনের মতকে একত্র করতে পারা বড় চ্যালেঞ্জ।
সার্বিক বিষয়ে নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, তরুণদের সম্মিলন ঘটেছে জাতীয় নাগরিক কমিটিতে। আইনজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, শ্রমিক সব শ্রেণিপেশার তরুণরাই রাজনীতিতে এগিয়ে আসছেন। ফ্যাসিবাদ এবং পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে রাজনীতির প্রতি যে ভীতি ও অনীহা তৈরি করেছিল, জাতীয় নাগরিক কমিটি তা ভেঙে দিচ্ছে। আশা করছি, আমরা অচিরেই বাংলাদেশকে একটি তারুণ্যনির্ভর উদ্যমী রাজনৈতিক দল উপহার দিতে পারব।
তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। জাতীয় যুব দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের একটা প্রজন্মান্তর ঘটে গেছে। তরুণরা বাংলাদেশকে নতুন করে পথ দেখিয়েছে। অর্থনীতিসহ সবকিছুতেই তরুণরা নেতৃত্বে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে প্রজন্ম জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছে, সেই প্রজন্মই বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, তরুণদের নিয়ে শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, সমগ্র পৃথিবী নতুন করে ভাবছে আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের তরুণরা এই জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে একটি নতুন পথ দেখিয়েছে। ফলে এই তারুণ্য বাংলাদেশকে পরবর্তী সময়ে কোথায় নিয়ে যাবে, পুরো পৃথিবী এখন সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। -দেশ রূপান্তর