মোহাম্মদ আব্দুল হক
পড়াশোনা কে আবিষ্কার করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে এক কথায় একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো একজনের নাম জানা যাচ্ছে না। তবে প্রশ্ন আছে, পড়াশোনা কেন এসেছে? হ্যাঁ, পড়াশোনা বা পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্য হলো, শোনা, জানা এবং জ্ঞান চর্চা দ্বারা জ্ঞান অর্জন করা। জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে এবং সম্মিলিতভাবে সকলে সুন্দর জীবন উপভোগ করতে প্রয়োজন অধিক অধিক পরিমাণে জ্ঞান সমৃদ্ধ মানুষের সমাজ। অথচ, এখনও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের মাথায় ছাত্রজীবনের শুরুতেই এমন কতোগুলো বাক্য চাপিয়ে দেয়া হয় যা চূড়ান্ত পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান চর্চার দিকে আকৃষ্ট না - করে কেবলই পরীক্ষায় পাস করার নেশায় আসক্ত করে। মনে মনে লক্ষ্য স্থির হয়ে যায় একেকটি শ্রেণির পরীক্ষা পাস করে যেনতেন প্রকারে একটা চাকরি নিয়ে প্রচুর টাকা সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়া। শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের কি দোষ ধরবো। অনেক অভিভাবক সন্তানের নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণি পাসের পরে সরকারি বা বেসরকারি চাকরি পাওয়া যাতে সহজ হয় সেজন্যে প্রয়োজনে ঘুষ দেওয়ার জন্য সারাজীবন যেনতেন উপায়ে টাকা জমিয়ে রাখেন। এভাবে ভুল চিন্তা, অনৈতিক চিন্তা নিয়ে পড়াশোনা করে শ্রেণি পাস করা মানুষের সমাজ কখনও সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ হয় না। এখানে অভিভাবকদের বড়ো একটা অংশ সকাল দুপুর বিকাল রাত সবসময় সন্তানদেরকে বলে থাকেন- “ভালো করে পড়াশোনা করো, না-হলে চাকরি পাবে না।” কেউ কেউ বলেন- “তোমাকে ডাক্তার হতে হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে, পুলিশ হতে হবে” ইত্যাদি আরও আরও এটা সেটা হতে হবে। বলতেই থাকেন বলতেই থাকেন। হ্যাঁ, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা পড়ালেখার ক্ষেত্রে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কিছু লক্ষ্য সামনে রাখা খারাপ না। কিন্তু জ্ঞানার্জন? সেটা-তো প্রায় সকলেই চাই, তাই-না! সেটা কিভাবে হবে? অনৈতিক চিন্তা দিয়ে জ্ঞানার্জন সম্ভব হবে না।
অস্বীকার করা যায় না, জ্ঞানার্জনের জন্য পড়তে হয়। আমি বুঝতে পারছি, আমার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও পড়াশোনা করে আরও শ্রেণি পাসের পাশাপাশি শিক্ষার্থী থাকাকালীন পাঠ্যবইয়ের সমান্তরাল আরও বই পড়ার প্রয়োজন ছিলো। এখানে অধিকাংশ মা-বাবারা সন্তানদেরকে পাঠ্যবইয়ের বাইরে বছরের বারোমাসে জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা, সাহিত্য ও দেশ-বিদেশের ইতিহাস জানার জন্য ছয়টি বই কিনে দেন না। অথচ সাহিত্য ও ইতিহাস মনের আনন্দ ও নিজের সমৃদ্ধির জন্য খুবই জরুরি। কবিতা মানুষকে ভাবায়। প্রবন্ধ সাহিত্য মানুষের মনোজগতকে সমৃদ্ধ করে। এই বিষয়টিতে অনেক মা-বাবা নির্মোহ উদাসীনতা দেখান। এতে করে পরবর্তী প্রজন্ম পরীক্ষা পাস করে গেলেও জ্ঞান থেকে দূরে থেকে যায়। কার্যত একেকটি পরিবার, সমাজ, দেশ ঠকে যায়। জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে সম্মিলিতভাবে মানুষ পিছিয়ে থাকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর জীবনের সন্ধান পেতে।
আমাদের নিজেদেরকে বইয়ের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে বইয়ের সংস্পর্শে রাখতে হবে। বছরে স্কুল কলেজের পাঠ্যবই, খাতা, কলম, প্রাইভেট টিউটর, প্রাইভেট কোচিং করার জন্য একেকজন সন্তানের পিছনে মা-বাবা যতো খরচ করেন, তার দশ শতাংশ পরিমাণ যদি সন্তানদের জ্ঞানার্জনের পিছনে খরচ করার চিন্তা থেকে বই কিনে দিতেন, তাহলে ওইসব সন্তানরা প্রকৃত জ্ঞানের আলো নিজেরা পেতো এবং পরিবার সমাজ রাষ্ট্র সবখানেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আলো ছড়াতো।
দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে একেকজন পিতা যতো টাকার ধূমপান করেন এবং একেকজন মাতা যতো টাকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করেন তার এক শতাংশ দিয়ে নিজেও বছরে বই কিনেন না। মনে হয় আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না আমাদের কোনটা সত্যি সত্যিই প্রয়োজন। আমাদের জানা দরকার কোনটা প্রয়োজনীয় এবং কোনটা আমাদের অপ্রয়োজনীয়। মা-বাবার জানতে হবে কোন বয়সে কোন সন্তানের জন্য কোনটা কতোটা প্রয়োজন। জানা থাকলে আমরা অনেক অপ্রয়োজনীয় চাহিদা থেকে দূরে থাকতে পারি। আমি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করা থেকে দূরে সরেছি। আপনিও চেষ্টা করলে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন নিজেকে। আমরা মা-বাবারা প্রত্যাশা করি সন্তানরা জ্ঞানী হবে, অথচ আমরা সে পথে হাঁটি না। এভাবে কি হবে? এভাবে কি হয়? আমার মনে হয় এভাবে হয় না। পড়তে হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা শুনতে হয় এবং জ্ঞান চর্চা করতে হয়। কবিতা ছড়া গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ পাঠ এবং এসব বিষয়ে মনোযোগী শ্রোতা নিজেকে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ করতে পারেন। পোশাক, গহনা ইত্যাদি যতোটা প্রয়োজন মনে হয়, বই কিন্তু তুচ্ছ নয়। মানস¤পন্ন সাহিত্য ও গবেষণা সমৃদ্ধ সব ধরনের বই মূল্যবান। দেখুন, প্রচুর টাকা সম্পদের মালিকও দেউলিয়া হয়। কিন্তু বইয়ের বিষয়বস্তুর জ্ঞানের নাই ক্ষয়। আমার প্রচুর টাকা স¤পদ নাই। আমি বইয়ের পৃষ্ঠায় লেখা পড়ে অনেক কিছুই পাই। আমি বইমেলায় যতোটা আগ্রহ নিয়ে যাই বাণিজ্যমেলায় তাতো যাই না, এর অর্থ এই নয়, আমি গরীব। আমি কষ্ট করে হলেও কিছু কিছু বই সংগ্রহ করি পড়ি এবং নিজে লিখি। আমার পড়ার অভ্যাস থেকে আমি নিজে বুঝতে পারছি একেকজন লেখক কতো কথা লিখে যান। আমারও অনেক কথা আমি লিখতে চেষ্টা করি। আমার কাছে অনেক লেখকের বই থাকে। আমি গরিব না। আমার একেকটি উপন্যাস আমার একেকটি দেশ। এ পর্যন্ত আমার দুটি দেশ। একটি ‘শ্বশুর বাড়ির জাঙ্গাল’, আরেকটি ‘বেপরোয়া নীলিমা’। মোহাম্মদ আব্দুল হক দুটি রাষ্ট্রের মালিক।
অধিক পড়াশোনা ও জ্ঞান চর্চায় সমাজে জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। কোনো সমাজে পর্যায়ক্রমে জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি না-পাওয়ার পরিণতি হচ্ছে নোংরা জলাশয়ের অন্ধকারের অসহায়ত্বে হাবুডুবু খেয়ে বাঁচা। যে সমাজে অল্প কিছু মানুষ জ্ঞান চর্চা করে এবং কিছুটা সুন্দর পথ খুঁজে পায়, তারা হয়ে যায় একা এবং সংখ্যালঘু। তাঁদেরকে বহুমুখী মানসিক চাপ সামলাতে হয় সারাজীবন। এতে করে সমাজ অন্ধকার থেকে মুক্ত হতে পারে না সহজে। এ থেকে মুক্ত হতে হলে প্রয়োজন বেশি বেশি মানুষের পড়াশোনা ও জ্ঞান চর্চা করা। আমাদের বছরের শেষটা হোক পড়াশোনার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে, আমাদের বছরের দিন গোনা শুরু হোক পড়াশোনার গুরুত্ব অনুধাবন করে। এ পথেই মানুষের সমৃদ্ধি। আসুন নিজে কিছু টাকার বই কিনে পড়ি। পরবর্তী প্রজন্ম এখান থেকেই একটা মজবুত সিঁড়ি পেয়ে যাবে। আমাদের সকলের মননের বিকাশ ঘটুক।
[মোহাম্মদ আব্দুল হক : কলামিস্ট ও কথাসাহিত্যিক]