দেশে শান্তি নেই। এটি কোনও নতুন কথা নয়। বাংলাদেশ কেন এই উপমহাদেশে শান্তিভঙ্গের অনেক অনেক কারণ ও ঐতিহাসিক উদাহরণ দেওয়া যায়। সেটা আবার কমবেশি সকলেরই জানা। এখানে উদাহরণ টানা জরুরি বলে মনে করছি না। রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা লেখেন, “পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছড়ে বাহির হইনু পথে করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে। এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে, তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।” এই কবিতার ‘মোহগর্ত’ শব্দটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
একটু ভাবনা করলেই বোঝা যায় ‘দুই বিঘার মালিক’ উপেন সম্পদে ব্যক্তিগত মালিকানার মোহ থেকে ‘রাজা’র (আসলে সামন্তযুগীয় শোষক জমিদার, উপেন তাকে রাজা বলে মানে।)
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দুই বিঘার পরিবর্তে ভগবানের লিখে দেওয়া বিশ^নিখিলের মালিক হয়ে গিয়ে আসলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিমালিকানার ‘আরও চাই’র ষাড়যান্ত্রিক ফাঁদে পড়ে উপেনের নিঃস্ব হয়ে পড়ার ভেতরে লুকানো মর্মবেদনার তীব্রতাকে প্রকাশ করেছেন কবি। এটার নামই রাজনীতি। যে-রাজনীতি সম্পদের উপর ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানবসভ্যতার ভেতরের অসভ্যতার আধিপত্য রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। উপেন এই অসভ্যতার বা রাজনীতির শিকার। এই অসভ্যতা কিংবা বর্বরতাই কবিকল্পনার কারসাজিতে হয়ে উঠেছে উপেনের ‘বিশ্বনিখিলের মালিক’ হয়ে উঠার প্রাহসনিক সান্ত¡না, যার একটাই নিহিতার্থ উদ্বাস্তুতা ও উদ্বাস্তুতার মর্মবেদনার ভয়ঙ্করত্ব।
উদ্বাস্তু এই উপেন শান্তি চায়। কিন্তু তার জন্যে ব্যক্তিমালিকানার পৃথিবীতে শান্তি কোথাও নেই। রবীন্দ্রনাথ যতো দিন জীবিত ছিলেন, তার আগেও উপেনরা ছিলো এবং এখনও আছে সমগ্র পৃথিবীতে, এই উপমহাদেশে, এই বাংলাদেশেও। তারা শান্তির প্রত্যাশায় জীবন কাটায়, শান্তি মিলে না।
বাংলাদেশে উপেনকে নিঃস্ব করে দেওয়ার লুটপাটের রাজত্ব কায়েম থাকে, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও, মুক্তি-শান্তি কীছুই মিলে না, বরং সম্প্রতি অশান্তির মেঘ আরও ঘনীভূত হয়েছে এবং অভিজ্ঞমহলের ধারণা তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের নাভিকেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে দেশ।
এমন ক্রান্তিকালে ও পরিস্থিতিতে ‘সুনামগঞ্জে ইয়ুথ পিস অ্যাম্বাসেডর গ্রুপ’ গঠন করা হয়েছে মর্মে সংবাদমাধ্যমে জানা গেলো। তাঁদেরকে ধন্যবাদ। তাঁরা ‘পিস’ শব্দটির মোড়কে ‘শান্তি’র সন্ধানে বেরিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষকে ব্যক্তিমালিকানার মোহগর্তে রেখে এক কণা শান্তিও অর্জন করা সম্ভব নয়। উপেনের ‘দুই বিঘার পরিবর্তে ভগবানের লিখে দেওয়া বিশ^নিখিলের মালিক হয়ে উঠার’ আর্থসামাজিক প্রবণতা প্রতিরোধ করা না গেলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত কখনওই হবে না। শোষণ ও শান্তি কখনওই সহাবস্থান করে না বলে মানুষে মানুষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কনওই সম্ভব নয়।