শামস শামীম
কবি হেলাল হাফিজ ব্যক্তিজীবনে এক মহান নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলেন। ভেতরে আগুন পোষা মানুষটি ছিলেন কথাহীন একেলা মানুষ। বাংলা কবিতায় তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অনাদর রয়ে সয়ে চলে গেলেন তিনি। মরে পড়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ হোস্টেলের বাথরুমে। নিঃসঙ্গ কবির শেষ বেলায় এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে বুকটা দিরিম দিরিম করছে। কেদেছে বোবা বেদনাগুলোও।
বহুরকমের কবিতার মধ্যে কবি হেলাল হাফিজের কবিতাও এক বিশেষ প্রজাতির। প্রেম ও দ্রোহ সমান্তরাল হেটেছে। জন্মভূমির মাটি মাখামাখি করে বসবাস করেছে। তার কবিতার সেই মাটিঘ্রাণ শুঁকে এদেশের কাব্য ও সাহিত্যের বাইরের তরুণরাও প্রেম ও দ্রোহের পাঠ নিয়েছে অবচেতনে। তারা কবিতায় দেয়ালকে করেছে বর্ণিল। দেয়াল হয়ে ওঠেছে সময়ের প্রোজ্জ্বল পাঠ আর রাজনীতির মাঠ।
তার কবিতা কখনো হয়ে ওঠেছে স্লোগান, কখনো পত্রপাঠ মুগ্ধতায় হয়ে ওঠেছে প্রেমিক-প্রেমিকার রঙিন উঠোন। জনসভার ভাষণ আর জীবনের বহুব্যঞ্জনার কোমল কঠোর সুরে সুরে এগিয়েছে কবিতা। কষ্টের ফেরিওয়ালা হয়ে সেই সুরে শাণ দিয়েছিলেন তিনি। কখনো ভিজিয়েছেন বেদনায়, প্রেমের কোমল পেলবতায় মাতিয়েছেন বড়ো একটা প্রজন্মকে।
কবি হেলাল হাফিজ নিঃসঙ্গ জীবনে এক নিভৃতচারী সাধক ছিলেন। ‘একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট’ চেপেই যাপন করেছেন একেলা জীবন। বিচ্ছেদের বিষে নীল কবি, কাব্যভুবনে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়েও আলাপে-সংলাপে ছিলেন না নিজে। বঞ্চনা আর বেদনাই ছিল তার নান্দনিক অলঙ্কার। নিঃসঙ্গ ও নিঃসহায় অবস্থায় বাথরুমে শেষ হয়েছে তার জীবনের কোলাহল। কেউ জানলইনা তিনি সেখানে মরে পড়ে আছেন। কারও যেন কোনও দায় ছিলনা! একটা জলজ্যান্ত মানুষ, প্রভাবশালী ও ভীষণ জনপ্রিয় একজন কবিকে সুখ শান্তির মৃত্যু দিতে পারলনা রাষ্ট্র! আফসোস!
হেলাল হাফিজের প্রেমের কবিতায় প্রিয়তমার মন জয় করেছে অনেক যুবক। প্রেয়সীর সান্নিধ্যে উতলা হয়ে দিয়েছে একপশলা চুমুক। হাত ধরে হেটে হেটে পৌঁছে গেছে বেদনার আঁকাবাকা পথে। ছ্যাকা খেয়ে আশ্রয় নিয়েছে তার কবিতায়। আরেকদলকে দিয়েছে সময়ের পাঠ। যৌবনের ধাত ও জাত চিনিয়েছে। টেনে এনেছে রাজপথে দ্রোহের সুরে সুরে। রাজপথে রঙিনফুল হয়ে মিটিয়েছে মানবজন্মের কলঙ্ক। গ্রামের ছাপোষা তরুণও কবিতার পঙক্তির শক্তিতে বলিয়ান হয়ে গেয়েছে যৌবনের গান।
আমিও প্রেম ও দ্রোহের ধারাপাত শিখেছি উঠতি বয়সে। কবির কবিতা ধার করে চিঠি লিখে তরুণীমহলে পেয়েছি কদর। বহুবন্ধুর চিঠি লিখে দিয়েছি কবিতার প্রোজ্জ্বল পঙক্তি দিয়ে। সবাই মিলে হল্লা করে প্রেমের গান গেয়েছি, গেয়েছি ছ্যাকা খাওয়ার গান তার কবিতায় বুঁদ থেকে। কত পড়ালেখাহীন প্রবাসী স্বজনের স্ত্রীর চিঠি লিখতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি কবির কবিতায়। যোজন দূরে থাকা স্বামী-স্ত্রীর আবেগের ছবি কল্পনায় এঁকে পুলকিত হয়েছি। কতভাবে প্রথম যৌবন ও কৈশোরে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র এক টেকসই ত্রিপালের নিচে স্বস্তি ও উচ্ছ্বাসে খুঁজেছি নিজেকে। মিছিলের সব হাত কণ্ঠ ও পাগুলোকেও চিনিয়েছিল নিষিদ্ধ স¤পাদকীয়তে।
মহান এই কবির মৃত্যুতে আমি পাতার মর্মর শব্দে শুনছি জাতীয় সঙ্গীত এক দুঃসহকালে। একটি পতাকার বেদনা নিয়ে চলে গেছেন আমাদের পরাণের পাখি। তার তরে অতল শ্রদ্ধা।
“পরাণের পাখি তুমি একবার সেই কথা কও,
আমার সূর্যের কথা, কাক্সিক্ষত দিনের কথা,
সুশোভন স্বপ্নের কথাটা বলো,-শুনুক মানুষ।”