বিশেষ প্রতিনিধি ::
দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে ২০২২ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় ‘পানিশমেন্ট’ বদলি করা হয় উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামকে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ‘দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত’ এই শিক্ষা কর্মকর্তা দুর্গম হাওর এলাকা শাল্লায় এসে ঘুষবাণিজ্যে আবারও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সঙ্গী করেন আওয়ামী লীগ সরকারের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও আওয়ামী লীগের শিক্ষক বলয়ের ৪-৫ জনের সিন্ডিকেট শিক্ষক নেতাদের। সিন্ডিকেট করে নিরীহ সাধারণ শিক্ষকদের জিম্মি করে নানাভাবে অর্থ হাতানোই একমাত্র নেশায় পরিণত হয় তার। তিনি তৎকালীন পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছোট ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আল আমিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বনে দলীয় ক্যাডারের মতো শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণ করেন এমন অভিযোগ আছে। এখন হাওয়া বদল করে ‘বিএনপি’ সাজার সব চেষ্টাই করছেন তিনি। ভুক্তভোগী শিক্ষক, তার পরিবার ও এলাকাবাসী জানান, শাল্লায় এসে ৪ জন শিক্ষক নেতাকে নিয়ে তিনি ‘ওপেন দুর্নীতি ’অব্যাহত রেখেছেন। এই শিক্ষক নেতাদের মাধ্যমেই নিরীহ শিক্ষকদের জিম্মি করে প্রকাশ্যে অর্থ হাতাচ্ছেন তিনি। শাল্লায় দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ পাওয়া, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত ও সুধীজনের বিক্ষোভের পর গাজিপুরে বদলি হয়ে যাচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
শিক্ষক, অভিভাবক ও স্থানীয় সুধীমহল জানান, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে শাল্লায় এসে তৎকালীন পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছোটভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আল আমিন চৌধুরীর সঙ্গে মিশে যান সালাম। গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ড. জয়া সেনগুপ্তাকে পরাজিত করতে নৌকার প্রার্থী আল আমিন চৌধুরী যেসব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ করিয়েছিলেন তার প্রধান ছিলেন আবদুস সালাম। আওয়ামী লীগ প্রার্থী আল আমিন চৌধুরীর নিজ ভোটকেন্দ্র আব্দুল মান্নান চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে সালাম ২৬৩২ ভোটের মধ্যে ২৩৩২ ভোট কাস্ট করিয়ে উপজেলায় রেকর্ড ভোট কাস্ট করিয়েছিলেন। নিজেই তিনি নৌকা প্রতীকে সিল দিয়েছিলেন এমন অভিযোগ ওঠে তখন।
শুধু আল আমিন চৌধুরীই নয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এবং প্রাথমিক বিভাগের দুর্নীতিবাজ প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সঙ্গে আল আমিন চৌধুরীর মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান সালাম। মন্ত্রণালয়ের ‘চাকরিচ্যুতির বরখাস্তের আদেশ’ থেকে বাঁচতে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কাছে চলে যান। পরে জাকির হোসেনকে ম্যানেজ করে চাকরিচ্যুতির বদলে চাকুরিতে ‘দুই ধাপ অবনমন’ করে রেহাই পান সালাম। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তাকে চাকরিচ্যুতি করতে চাইলেও সালাম প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে ঘুষের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে বেঁচে গিয়েছিলেন।
সালাম যেসব এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন সেসব এলাকায় খোজ নিয়ে জানা গেছে, সবখানেই প্রকাশ্যে দুর্নীতি করে তিরষ্কৃত হয়েছেন তিনি। রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা সদরে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রমাণিত হলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে (স্মারক নং ৩৮.০০.০০০০.০০৪.০৪.০১১.১৯-১০৪) তাকে চাকরিচ্যুতির সিন্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। ওই স্মারকে তাকে দুই ধাপ অবনমন করা হয়েছিল প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নির্দেশে। তদন্তে দুর্নীতিবাজ হিসেবে প্রমাণিত কর্মকর্তাকে বাঁচানোয় তখন ক্ষোভ প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা। লেনদেনের মাধ্যমে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন ও মাথার উপরে আশীর্বাদ হিসেবে পুলিশ প্রধানের ভাই আল আমিন চৌধুরী থাকায় তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। চাঁদা দিতে অপারগতা বা প্রতিবাদ করলে তিনি প্রতিবাদী ও নিরীহ শিক্ষকদের শায়েস্তার হুমকি দেন এবং মনগড়া পানিশমেন্টও দেন। একের পর এক দুর্নীতির টাকায় সব কিছু ধামাচাপা দিয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালাম। তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দেন শাল্লার ৪ শিক্ষক সিন্ডিকেটের দুর্নীতিবাজ শিক্ষক নেতারা। নিয়ম ভঙ্গ করে তিনি স্কুল ভিজিটে ওই শিক্ষক সিন্ডিকেটকে নিয়ে যেতেন এবং মোটা অংকের টাকা নিয়ে আসতেন ভিজিটের নামে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন বিদ্যালয়ের তালিকা চায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। এলাকাবাসী জানিয়েছেন গত বন্যায় শাল্লা উপজেলায় একটি বিদ্যালয়েও পানি প্রবেশ করেনি। তারপরও এই সুযোগ নিয়ে শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম ৪-৫ জন শিক্ষকের সিন্ডিকেটকে নিয়ে মনগড়া একটি তালিকা করেন। ওই তালিকার ভিত্তিতে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে পিইডিপি-৪ এর আওতায় এডুকেশন ইন ইমার্জেন্সি খাতে উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি বিদ্যালয় মেরামত ও সংস্কার কাজের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩৪টি বিদ্যালয় ২ লাখ টাকা করে ও ১৪টি বিদ্যালয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা সংস্কার বরাদ্দ পায়। সালাম বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে ৪০-৩০ হাজার টাকা করে প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়াও বিদ্যালয়ের ক্ষুদ্র মেরামত, স্লিপ ফান্ড, প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষা উপকরণ কেনার বরাদ্দ থেকে নির্দিষ্ট হারে ঘুষ নিয়েছেন। শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ও হাওর ভাতা ছুটানোর নামেও তিনি প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে ঘুষ নিয়েছেন। এছাড়াও অনলাইন বদলি কার্যক্রমে অগ্রবর্তী প্রতিবেদনের জন্য আন্তঃজেলা বদলির আবেদনকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়েছেন। যারা অর্থ দেননি তাদের আবেদন বৈধ হলেও তিনি আবেদন অবৈধ বলে বাতিল করে দিয়েছেন। এছাড়াও পুরনো কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন তিনি নিয়মানুযায়ী বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে মোটা অংকে বিক্রি বিক্রি করে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে হবিবপুর ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘গুগলে শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালামের দুর্নীতি’ লিখে সার্চ দিলে শত শত নিউজ আসে। এত দুর্নীতি করে তিনি কিভাবে রেহাই পান ভাবলেই আতকে ওঠি। সম্প্রতি তার বিদ্যালয়ে বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত বরাদ্দের ৪০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি। নির্ধারিত কমিশন কেন নেওয়া হবে এটা নিয়ে তিনি কথা তুলে হুমকি পেয়েছিলেন বলেও জানান ওই শিক্ষক।
বাহাড়া ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমিও ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। যতগুলো স্কুল বরাদ্দ পেয়েছে সবাইকেই ৩০-৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আমাদের হাত-পা বাধা তাই কথা বলতে পারছিনা। প্রতিবাদ করলে ৪-৫ জনের শিক্ষক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
শাল্লা উপজেলা বিএনপির সভাপতি গণেন্দ্র চন্দ্র সরকার বলেন, শুনেছি এই কর্মকর্তা যেখানে গেছেন সেখানেই দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছেন। এবং শাল্লায়ও পানিশমেন্ট বদলি হয়ে এসেছিলেন। এখানে এসেও নানা অনিয়মে জড়িত থাকায় তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভও করেছে। যদিও আমি অফিসে যাই না তারপরও মনে করে সত্যতা আছে বলেই তার বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ হয়েছে।
অভিযুক্ত আব্দুস সালাম বলেন, আমি হাইকোর্টে রিট করে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় পেয়েছি। আমি অনিয়মে জড়িত নই।