সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসিন্দা রাশেদা খাতুন। চল্লিশোর্ধ্ব এ নারী বছরখানেক ধরে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত। নিয়মিতভাবে চিকিৎসাসেবা নিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেতেন। সম্প্রতি দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারতের ভিসা পেতে দীর্ঘসূত্রতা ও বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। ভোগান্তি বাড়ায় রাশেদা খাতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশেই ক্যান্সারের চিকিৎসা নেবেন তিনি। কিন্তু এখানে চিকিৎসা সেবার মান ও ব্যয় সাশ্রয় নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগে ভুগছেন তিনি।
দেশে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ছে। যদিও এর চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আবার চিকিৎসাসেবা ও সুবিধাও অপ্রতুল। এ কারণে প্রতি বছর ক্যান্সারের চিকিৎসাসেবা নিতে প্রতিবেশী ভারতে যাচ্ছেন আক্রান্তদের বড় একটি অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে ভিসা নিয়ে জটিলতা বাড়ায় তাদের অধিকাংশই এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া শুরু করেছেন। তবে ক্যান্সার চিকিৎসায় দেশের হাসপাতালগুলোয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল না থাকায় উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই সঙ্গে ব্যয়বহুল এ চিকিৎসার খরচ জোগানো নিয়েও ভুক্তভোগীদের রয়েছে বড় ধরণের দুশ্চিন্তা।
দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ ক্যান্সারের রোগী শনাক্ত হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসা গবেষকরা। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষকদের করা জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি এক লাখে ১১৪ জন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। গবেষণাটিকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নিলেও দেশের মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩০ লাখের মধ্যে ক্যান্সারের রোগী আছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ২০০ জন।
বিপুলসংখ্যক এ রোগীর দেশে চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো সক্ষমতা নেই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর। ফলে ক্যান্সার আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের ওপর নির্ভরতা দিনে দিনে বেড়েছে।
দেশে ক্যান্সার চিকিৎসা ও সেবার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সম্মান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুবাইয়ুল মুর্শেদ বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। একজন রোগী যে চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা শুু করেন, তিনি ওই চিকিৎসকের কাছেই চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষ করতে চান। চিকিৎসার মাঝ পর্যায়ে চিকিৎসক পরিবর্তন করতে হলে নতুন চিকিৎসকের সঙ্গে মানিয়ে নেয়াসহ পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন জটিলতা তৈরি হয়। এছাড়া ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন রোগীকে মাঝ পর্যায়ে চিকিৎসক পরিবর্তন করতে হয়, তখন রোগীর মধ্যে মানসিক উদ্বেগ তৈরি হয়, যা চিকিৎসায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে ক্যান্সারের রোগীদের বড় একটি অংশ চিকিৎসার জন্য বেছে নেন ভারতকে। ভিসা জটিলতায় এসব ভুক্তভোগী এখন বিপদে পড়েছেন। বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক।
গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০২২ সালে নতুন করে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৭ জন। আর ওই বছর দেশের ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যু হয় ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জনের। আর ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে (২০১৮ সাল থেকে) বাংলাদেশে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৭।
গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি ২০২২ সালে ক্যান্সার রোগী শনাক্তের তথ্য বিশ্লেষণে জানিয়েছে, ওই বছর বাংলাদেশে ক্যান্সার শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৯২২। আর নারী ৭২ হাজার ৩৩৪। আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল খাদ্যনালির ক্যান্সারে আক্রান্ত, যার সংখ্যা ২৫ হাজার ২৩২ বা মোট নতুন শনাক্তকৃত রোগীর ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। ঠোঁট বা মুখের অভ্যন্তরে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ১৬ হাজার ৮৩ জন। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ১৩ হাজার জন, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ১২ হাজার ৯৮৯ জন, জরায়ু মুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে ৯ হাজার ৬৪০ জন। এছাড়া অন্যান্য ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৯০ হাজার ৩১২।
সেবামানের অপ্রতুলতার পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচের কারণেও চিকিৎসাসেবার জন্য ক্যান্সার আক্রান্তদের বিদেশনির্ভরতা বাড়ছে। শুধু ব্যয়ের কারণেই দেশের অনেক ক্যান্সার রোগী এখানে স¤পূর্ণ চিকিৎসা নিতে পারছেন না। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের নি¤œ-মধ্যবিত্ত মানুষকে ক্যান্সার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। দিন দিন এ খরচ আরো বাড়ছে। তাছাড়া ক্যান্সারের চিকিৎসা সব ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় এ রোগের চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে সেখানেও রোগীর তুলনায় জনবল ও চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালগুলোয় রেডিওথেরাপি স¤পূর্ণ কোর্স শেষ করতে খরচ পড়ে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় খরচ হয় ১ থেকে ৩ লাখ টাকা।
সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় ক্যান্সার রোগী প্রায় ৫০ শতাংশ কমে চিকিৎসা করাতে পারে। তবু বেশির ভাগ মানুষ পুরো চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে পারে না, যার কারণে অনেকে মাঝপথেই চিকিৎসা নেয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী রাশেদা খাতুন এ বিষয়ে বলেন, দেশের একটি হাসপাতালে পেটের সিটি স্ক্যান করাতে খরচ হয় ৬৫ হাজার টাকার মতো। কিন্তু ভারতে এ ব্যয় ২৪ হাজার রুপি। সরকারি কোনো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ হয়তোবা কম পড়ত। কিন্তু সেসব হাসপাতালে সবাই সুযোগ পায় না। এজন্য আমার মতো অনেক ক্যান্সার রোগী ভারতে যায় চিকিৎসার জন্য।
বাংলাদেশের ক্যান্সার রোগীদের একটি বিশাল সংখ্যা ভারতে যেত চিকিৎসার জন্য। তবে দুই দেশের মধ্যকার সাম্প্রতিক কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে ভারতে এখন মেডিকেল ভিসা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা ফলোআপ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ রোগীরা।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে সেখানে চিকিৎসার জন্য যায় প্রায় ২৫ লাখ রোগী। দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসব রোগী বছরে সম্মিলিতভাবে ব্যয় করছেন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির ভাগ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেয়ার যন্ত্রগুলো নষ্ট। কেমোথেরাপি ঠিকঠাকভাবে দেয়া গেলেও রেডিওথেরাপি ঠিকঠাকভাবে দিতে পারছেন না তারা। রেডিওথেরাপির যন্ত্রগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা লাগে। আগের তুলনায় রোগীর চাপ বাড়লেও সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারছে না সরকারি মেডিকেল কলেজগুলো। কোথাও পর্যাপ্ত যন্ত্র আছে, লোকবল নেই। আবার কোথাও লোকবল আছে, তবে যন্ত্রাংশ নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোর জনবল ও চিকিৎসাসেবায় ব্যবহার্য যন্ত্রপাতির সংখ্যা বাড়ানো গেলে দেশে আরো অনেক ক্যান্সার রোগীকে পর্যাপ্ত মাত্রায় চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হবে।
মেডিকেল অ্যান্ড রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট এবং বগুড়া টিএমএসএস ক্যান্সার সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। তবে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর জনবল এবং রেডিওথেরাপি মেশিন দুটোই বাড়ানো উচিত। তাহলে আমরা অনেক রোগীকে চিকিৎসা দিতে সক্ষম হব।