সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
খেলাপি ঋণ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।
শুধু ব্যাংক খাতেই নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণকৃত ৩৩ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, আগামীতে খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলাপি ঋণে নি¤œগতির সুসংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংকট কাটাতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তবে এখন খেলাপি ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা, যা নিয়ে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ওই সময় দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ খেলাপি ছিল। গত মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা এবং এর আগে ডিসেম্বরে ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এই প্রথম খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে, খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতেও নেওয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। এখন সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি ঋণ কমার লক্ষণ নেই মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী। বৈশ্বিক মানদন্ড মানলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে উল্লেখ করে গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কখন কমবে তা নির্ভর করছে ব্যাংকগুলো কত দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে কত কঠোর হতে পারবে তার ওপর। এখন পর্যন্ত সুলক্ষণ আমরা দেখছি না। বৈশ্বিক মানদন্ডে দেখাতে হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। কতদিনের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমবে, তা অনুমান করা কঠিন। নতুন করে যেন খেলাপি ঋণ না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংক সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে। এমন নীতিমালা করতে হবে যাতে নতুন করে আর খেলাপি ঋণ না হয়। নতুন যেসব ঋণ দেওয়া হচ্ছে সেগুলোও যদি খেলাপি হতে শুরু করে তবে খেলাপি ঋণের নি¤œগতি আশা করা কঠিন। দ্বিতীয়ত, খেলাপি ঋণ আমরা কত দ্রুত এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আদায় করতে পারছি তার ওপর নির্ভর করছে খেলাপি ঋণ কবে কমতে শুরু করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। দ্বিতীয়বার ক্ষমতা নেওয়ার সময়ও তা ছিল অর্ধলাখ কোটি টাকার মধ্যে। অর্থাৎ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দেশের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। তৃতীয় দফা ক্ষমতা নেওয়ার সময় অর্থাৎ ২০১৮ সালের শেষে দেশের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সমস্যার গভীরতা নির্ণয় করাটাই বড় বিষয়। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়। এতদিন কার্পেটের নিচে কত ময়লা ছিল সেটাই জানা ছিল না। এখন জানা যাচ্ছে। এখন শনাক্ত করতে হবে কোন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কী অবস্থায় আছে, কোনটা মন্দ ঋণ, কোনটা সন্দেহজনক ঋণ। সে অনুযায়ী কত প্রভিশনিং করতে হবে তা স্পষ্ট করতে হবে।
তিনি বলেন, আমার জানামতে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক এখন করছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের কোনটা ইচ্ছাকৃত, কোনটা অনিচ্ছাকৃত এসব আলাদা করতে হবে। এসবের বিপরীতে তাদের অ্যাসেট কীরকম আছে, শেয়ার কত আছে সেসব বের করা হবে। কিছু কাঠামোগত সিদ্ধান্তও নিতে হতে পারে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর কোনটাকে এক্সিট দেওয়া, কোনটাকে একীভূত করা হবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে সঞ্চয়কারীদের বিষয়টা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে।
শুধু ব্যাংক খাতেই নয়, খেলাপি ঋণ বেড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও, গত জুন শেষে এ খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৭১০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট ঋণের ৬.৭ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকায়। ২০১৭ সালে তা বেড়ে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালে ছাড়ায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩ সালে আরও বেড়ে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। গত জুনে তা আরও বেড়ে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুল আউয়াল সরকার বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজন কঠোরতা ও আন্তরিকতা। গভর্নর কিছুদিন আগে স¤পদ অধিগ্রহণের কথা বলেছিলেন। এটা করা গেলে খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশ আদায় করা সম্ভব।
তিনি মনে করেন, এখন খেলাপি ঋণের বড় অংশ শরিয়াহ ব্যাংকগুলোতে। অথচ শরিয়াহ আইনের কার্যকারিতা আমরা কখনো দেখিনি। দেউলিয়া আইনের আমরা দেখি না।
আবদুল আউয়াল সরকার বলেন, রিটের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ ঝুলিয়ে রাখা হয়। রিটের সুরাহা যদি করা যায়, যদি ৩০-৪০ শতাংশ খেলাপি আদায় করার পর রিটের সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে খেলাপি আদায় বাড়বে।
সম্প্রতি ব্যাংকঋণের মান নির্ধারণে আবারও আন্তর্জাতিক চর্চা শুরু করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন পর খেলাপি হয়ে যাবে। খেলাপি ঋণের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান কঠোর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। - দেশ রূপান্তর