মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ‘রেনেসাঁ’র স্বপ্ন দেখেছিলেন লেখক আহমদ ছফা। দীর্ঘদিন পর পাক হানাদার বাহিনীর শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশীদের নিয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল আহমদ ছফার। অনেকটা ইউরোপীয় রেনেসাঁর মতো বাংলাদেশেও শুরু হবে এক নবযুগ, নতুন অধ্যায় এবং নতুন প্রজন্মের যারা যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাবে - এমন স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াত আহমদ ছফাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, পাকিস্তানি শাসন ও শোষণ শেষ হয়, বাংলাদেশী শরণার্থীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দেশে ফিরে আসে কিন্তু আহমদ ছফার রেনসাঁর স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র এমন হয়ে গিয়েছিল যে, মানুষ নিজের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না, সংখ্যালঘুদের জমিজমা দখল ও লুটপাট হচ্ছিল এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে অভাব-অনটন। এ সময় আহমদ ছফার কল্পিত রেনেসাঁ বাস্তবে রূপ পাওয়া দুরূহ বিষয় হয়ে গিয়েছিল। তার কল্পনা কল্পনাই থেকে যায়।
‘রেনেসাঁ’ হলো ফরাসি শব্দ যার অর্থ ‘পুনর্জাগরণ’ বা ‘পুনর্জন্ম’। এক কথায় বললে, চিন্তার জগতে বিপ্লব এবং পুরনো চিন্তা মুছে ফেলে নতুন চিন্তার আবির্ভাব। সামষ্টিকভাবে একটা জাতির মধ্যে চিন্তার বিপ্লব দেখা যায়, তা থেকেই শুরু হয় একটা জাতির পুনরুত্থান তথা পুনর্জন্ম। এ পুনর্জাগরণের শুরু হয় মানুষের মূল্যবোধ বিকাশের মধ্য দিয়ে, জানার মধ্য দিয়ে, উপলব্ধির মধ্য দিয়ে, বোধ জাগ্রত হওয়ার মধ্য দিয়ে। মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, বিশুদ্ধ চিন্তাধারার হাত ধরেই রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়। চিন্তাচেতনা ও মানবিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ শুরু হলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে বাহ্যিক সমাজ ব্যবস্থার ওপর। মানুষের ভেতরের পুনর্জাগরণই প্রতিফলিত হয় সমাজ ব্যবস্থায়, যার ফলে গড়ে ওঠে সুন্দর সামাজিক পরিবেশ। রেনেসাঁর একটা পূর্ব শর্ত আছে, সেটা হলো প্রথমে নিজের মধ্য থেকে রেনেসাঁর শুরু হওয়া। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ ফিরে এলে পুরো সমাজে সেই মূল্যবোধ ফিরে আসে। রেনেসাঁ একটি জাতি ও রাষ্ট্রকে নতুন পথে ধাবিত করে।
রেনেসাঁর দুটি দিক সরাসরি বিদ্যমান। একটি বাহ্যিক, অন্যটি অভ্যন্তরীণ। আত্মবিপ্লব হলেই মূলত বহির্বিপ্লব হওয়া সম্ভব। আত্মবিপ্লবের সৌন্দর্য বাইরে ফুলের মতো ফুটে ওঠে। বাংলাদেশে সরকারি খাতে দুর্নীতির অনেক চিত্র সাধারণ মানুষ দেখেছে। টাকা পাচার, ব্যাংক লুটপাট, প্রশ্নফাঁস ও ঘুষসহ নানা অপকর্ম পত্রিকার হেডলাইনে হয়েছে। যারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আসীন তারা সবাই শিক্ষিত কিন্তু তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, সততা ও নিষ্ঠা কাজ করেনি। রেনেসাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, খারাপ দেখলে নিজের ভেতর থেকে বাধা দেয়া। যে মানুষ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকেও অপরাধে জড়িত ছিল তাদের মধ্যে কোনোভাবেই মানবিক মূল্যবোধ ছিল না ফলে অপকর্মে বাধা দেয়ার পরিবর্তে তারা নিজেরাই অপকর্ম পরিচালনা করত। আমাদের দেশের প্রকৃতিও লুটপাট হয় কিছু মানুষের সিন্ডিকেটে। ফলে বন উজাড়, নদী ভরাট, নির্বিচারে। পাহাড় কাটা এসবের সরাসরি প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। আরো আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। মানুষের মূল্যবোধ বিকশিত না হওয়ার সঙ্গে এসব বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বন, নদী ও পাহাড় নিয়ে আলাদা আলাদা আইন থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এসব প্রকৃতি লুটপাট হয়? তার গভীরে যেতে গেলে দেখা যাবে রাষ্ট্রের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা এসব কাজে সহায়তা করছে। যদি একজন মানুষ ভেতর থেকে পরিশুদ্ধ হতো সে বাধা দিত এবং এসব রক্ষায় সোচ্চার হতো। মানবিক মূল্যবোধ, সততা ও নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠিত হলে মানুষ ভেতর থেকে সত্য ও সৌন্দর্যের পূজারী হয়ে ওঠে। সুন্দরকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। আর সুন্দরের আদি উৎস প্রকৃতি।
রেনেসাঁর হাওয়া কিছুটা হলেও লেগেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। শিক্ষার্থীদের রঙের তুলিতে শিল্প জায়গা করে নিচ্ছে ক্যা¤পাসের দেয়ালগুলোয়। শিক্ষার্থীরা এখন চায় ক্যা¤পাসগুলো রাজনীতি মুক্ত হয়ে মানবিক হয়ে উঠুক। সাম্যের ভিত্তিতে ক্যা¤পাস পরিচালিত হোক। মিছিলে যাওয়ার পরিবর্তে লাইব্রেরি ও রিডিংরুমে নিজেদের চিন্তার উন্নয়ন করতে চায় শিক্ষার্থীরা। তারা চায়, শিল্প, দর্শন ও বিভিন্ন জাতির চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হতে এবং নতুন আবিষ্কার নিয়ে জানতে। শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতিকে যেমন ঘৃণা করেছে তেমনিভাবে তারা ঘৃণা করেছে শিক্ষক রাজনীতিকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ দূর হয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ হওয়ায় একজন শিক্ষক যতটুকু না শিক্ষক হয়ে ওঠেন তার চেয়ে বেশি হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক ব্যক্তি। শিক্ষকরা লাল, নীল রঙে বিভক্ত হয়ে যে অরাজকতা চালাতেন শিক্ষার্থীরা তাও প্রত্যাহার করেছেন। শিক্ষার্থীরা চায়, ক্যা¤পাসগুলো হবে মানুষ গড়ার ও মানুষ হয়ে ওঠার জায়গা। রাজনীতি নয় বরং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ক্যা¤পাস পরিচালিত হবে, এ স্বপ্ন তাদের দীর্ঘদিনের। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা, মানবিক মূল্যবোধ, চিন্তার বিশুদ্ধতা ও গবেষণার পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ক্যা¤পাসগুলো হয়ে উঠবে আলো ছড়ানোর জায়গা। এ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসবে আদর্শ মানুষ। আর মানবিক মূল্যবোধের মানুষরাই হয়ে উঠবে একেকজন আলোকবর্তিকা। এ পথ দেখিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দুবার বাংলাদেশে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বৈরশাসককে বিদায় করতে অনেক শিক্ষার্থীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সর্বশেষ স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে ৫ আগস্ট। আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পাকাপোক্ত হয়। নয় দফা থেকে এক দফা দাবিতে সবাই অবস্থান নেয়। স্বৈরাচার পালায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার স্বৈরাচারের জন্ম হয় কেন? কেন এত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের জীবন যায়? এর ভিন্ন উত্তর হতে পারে। স্বৈরাচার পালানোর পর বিপ্লব চুরি হয়ে যায়, চুরি হয়ে যায় স্বপ্ন। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। যে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এক হয়েছিল সে শিক্ষার্থীরা বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গঠনের দায়িত্ব নিয়েছে। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই কিন্তু শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে। রেনেসাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, স্বার্থ ও ভোগবাদী চিন্তাকে পরিহার, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায়। স্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তা না করে দেশ রক্ষায় তারা কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা গঠন করেছে ছোট ছোট দল যাতে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর নিরাপদ থাকে, মন্দিরে যেন কেউ হামলা করতে না পারে, যেন কেউ চাঁদাবাজি করতে না পারে, যেন কেউ বিপ্লব চুরি করতে না পারে। শিক্ষার্থীরা ৬ আগস্ট পুরো বাংলাদেশে পরিষ্কার অভিযানে নেমে পড়ে। এখনো তারা প্রত্যেক দিন শহরগুলো পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করছে। গণভবন থেকে লুটপাট হওয়া অনেক জিনিসপত্র উদ্ধার করে তারা ফিরিয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনীর কাছে। এ আন্দোলনের আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণভাবে লক্ষণীয়, সেটা হলো০ আন্দোলনে বেশকিছু আইকনিক পেইন্টিং, গান ও কবিতা তৈরি হয়েছে। এগুলো সাংস্কৃতিকভাবে পথ দেখাতে পারে আগামীতে। কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ, বিপ্লবকেন্দ্রিক বিভিন্ন র্যাপ গান এবং কবিদের কবিতা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ আন্দোলন মফস্বল পর্যন্ত ছুঁয়ে গেছে, ফলে গোটা বাংলাদেশই ‘আত্মপরিচয়’-এর পাটাতন নতুনভাবে দাঁড় করাচ্ছে বলা যায়।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বোধোদয় থেকে আলো মেলতে পারে রেনেসাঁর, মানবিক মূল্যবোধস¤পন্ন সমাজের। এ শিক্ষার্থীরা চায় মতিউর ও বেনজীরের মতো কেউ দেশ লুটপাট না করুক, তারা চায় পাহাড় কেউ না কাটুক, নদী কেউ দখল না করুক, অবিচার না থাকুক। শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধের আলো ছড়িয়ে পড়–ক।