মোহাম্মদ আব্দুল হক
জুলাই-অগাস্ট'২৪ ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন এক সংগ্রামী ইতিহাস রচিত হয়েছে। উচ্চারিত হচ্ছে নতুন স্বাধীনতা শব্দটি। আবেগকে প্রাধান্য দিতে হয়। তারপরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস জ্বলজ্বলে ইতিহাস কথা কয়। ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস।
বাংলাদেশ নামের দেশটির সাথে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের উপর বারবার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট শাসকদের জুলুম নির্যাতন শোষণ এবং একইসাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠা ছাত্র জনতার সংগ্রাম স্বাধীনতা ও বিজয়ের ইতিহাস। এ দেশের জনগণের সংগ্রাম ও বিজয়ের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও মোটামুটি সকলের জন্য ব্রিটিশ ভারতের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তির মাইলস্টোন ১৯৪৭ খ্রীষ্টিয় সালের ভারত - পাকিস্তান ভাগের সময় থেকে কিছু কিছু বিষয় জেনে রাখা অত্যাবশ্যক। ১৯৪৭ খ্রীষ্টিয় সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হয় আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ। তারপর পাই ইতিহাসের নানান পরতে পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের ধারাবাহিক ঘটনা সমূহ- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ খ্রীষ্টিয় সালের সাধারণ নির্বাচনে এ অঞ্চলের মানুষের বিজয়কে পাকিস্তানি শাসকদের মেনে না-নেয়া। এরপর এ অঞ্চলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে যার যা-কিছু আছে তাই নিয়ে আমাদের স্বাধীন একটি দেশের জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আমাদের এই দেশটির স্বাধীনতার জন্য সরাসরি মরণপণ করে সংগ্রাম চলে ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ২৬ মার্চ থেকে। এ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ জীবন উৎসর্গ করে নিজেদের একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশের জন্য। ওই সংগ্রামে এদেশের প্রায় দুই লক্ষ নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারায় পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর হাতে। ওই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নাড়া দিয়েছিলো।
পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের পাশে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী এগারোটি সেক্টরে পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করে দেশের একেকটি অঞ্চল মুক্ত করতে থাকে। এরপর আমাদের একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশের জন্য চূড়ান্ত বিজয় হয় ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ১৬ই ডিসেম্বর। এইদিন পাকিস্তানি মিলিটারির প্রায় বিরানব্বই হাজার সৈন্য ঢাকায় আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর বুকে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নানান আন্দোলন সংগ্রামের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
আমাদের খ্রীষ্টিয় ক্যালেন্ডারে বিভিন্ন মাসে এমন কতোগুলো তারিখ আছে যেগুলো বিগত প্রায় তিপ্পান্ন বছর ধরে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশের মানুষকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। ওইসব তারিখের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদেরকে আন্দোলিত করে বারবার। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বাংলাদেশ নামক ভূখ-ের প্রতি পরতে পরতে আছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ও বিজয়ের ধারাবাহিকতা। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে ২০২৪ খ্রীষ্টিয় সালের জুলাই - অগাস্ট মাসে ঘটে গেল এক ছাত্র-জনতার বিপ্লব। আমি বলি, ছাত্র-জনতা-মিলিটারির অগাস্ট বিপ্লব। এক্ষেত্রে আমাদের সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার বিপ্লবকে চ্যালেঞ্জ করে কঠোর না-হয়ে শান্তিময় ভূমিকা নিয়েছে। এবছর অগাস্ট মাসের ৫ তারিখ প্রায় পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার বিপ্লবে দেশ ছাড়েন। ওই আন্দোলনে সেনাবাহিনী ছাত্র জনতার উপর মারাত্মক কোনো হামলা বা বাধা দেয়নি। বরং পরবর্তীতে খুব দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে সেনাবাহিনী শান্তির উদ্যোগ নিয়েছে। ৮ অগাস্ট ২০২৪ থেকে বাংলাদেশে গঠিত হয়েছে বিশ্ববরেণ্য নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারকে আমি বলি বিপ্লবী সরকার। এ সরকার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার করা। নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার শেষে শান্তিময় পরিস্থিতিতে নির্বাচন করার পরিবেশ সৃষ্টি হলে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি বিএনপি, জামায়াতে ইসলামসহ প্রায় সকলেরই সমর্থন রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে কিছু লিখতে গেলে ঐতিহাসিক বাস্তবতায় চলে আসে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, নব্বইয়ের গণআন্দোলন ইত্যাদি। ১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এ বছরের মার্চেই পাকিস্তানি আর্মি বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে আর ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর তারা ট্যাংক বন্দুক নিয়ে চালায় নৃশংস হত্যাকা-। নেতাহীন এ অঞ্চলের মানুষ যখন দিশাহারা ঠিক তখন বাঙালি আর্মি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান দেশের টানে চট্টগ্রামে থাকাকালীন তাঁর সিনিয়র অফিসার পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দী করেন এবং বিদ্রোহ করেন। তৎকালীন সময়ের শক্তিশালী পাকিস্তানি মিলিটারির বিরুদ্ধে এমন সাহসী কাজটি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এরপর চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে ভেসে আসে এক বীর সৈনিক মুক্তিযোদ্ধার সাহসী কণ্ঠের আওয়াজ। হ্যাঁ, জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ শুনে মানুষ আরও অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধে লড়ে। ছড়ার ছন্দে পড়ি- বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার ডাক / সে ডাক শুনে পাকবাহিনী হলো হতবাক / পঁচিশ মার্চ পাক বাহিনী করলো ঢাকায় গুলি / রাখাল আর মজুর নিলো লাঠি হাতে তুলি। / কালুরঘাট বেতারযোগে মেজর জিয়ার ঘোষণা / মুক্তিযোদ্ধার প্রাণে জাগায় নতুন এক প্রেরণা / বীর বাঙালি যুদ্ধে লড়ে মোট এগারো সেক্টরে / পাক-রাজাকার ভয়ে মরে বাংলাদেশের হেক্টরে। / যুদ্ধ করে স্বাধীন হলো আমার সবুজ বাংলা / ইয়াহিয়া আর নিয়াজি এবার ঠেলা সামলা / মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ যে গেল ত্রিশ লক্ষ বাঙালির / ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ হাসি এলো বিজয়ীর।
যে কোনো দেশে স্বাধীনতার প্রথম দিকে কিছুটা অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হয়। আমাদের দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭২ খ্রীষ্টিয় সালের সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ১৯৭৩ খ্রীষ্টিয় সালের মার্চ মাসে সংবিধান সংশোধন হয়। ১৯৭৫ খ্রীষ্টিয় সালের ২৫ জানুয়ারী দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এবছর ১৫ অগাস্ট ঘটে বঙ্গবন্ধু হত্যা। এরপর ১৯৭৮ খ্রীষ্টিয় সালের ৩ জুন দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ খ্রীষ্টিয় সালে দেশে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি উন্নয়ন এগিয়ে চলে। এই সময়ে দেশে দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এখানে চলে গেছে স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর। দীর্ঘ ইতিহাস এই স্বল্প পরিসরে জায়গা হবার নয়। দেশ এগিয়ে যায় আবার গণতন্ত্র হোঁচট খায়। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র জনতার কাছে দুঃশাসন বেশিদিন টিকতে পারেনি কোনো সময়। এমনই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ এর অগাস্টে ছাত্র জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন হয়। এখন দেশে বহুমুখী সংস্কারের পাশাপাশি চলছে উন্নয়ন। এভাবে চলতে চলতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আমরা আবারও সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা করছি।
সবখানেই বিপ্লবের পরে কিছুটা অস্থিরতা দেখা যায়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পরে দেখা যাচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। তবে দেশের জনগণ দ্রব্যমূল্য নিয়ে খুব কষ্টে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা আছে। তৈরি পোশাক শিল্পের অস্থিরতা দেখা যায়। পরিবহন সেক্টরে যথেষ্ট এলোমেলো পরিস্থিতি বিরাজমান। আশাবাদী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুব কম সময়ে এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। ধীরে ধীরে ২০২৪ জুলাই - অগাস্ট বিপ্লব পরবর্তী অস্থিরতা কমে আসবে। জুলাই - অগাস্ট ছাত্র - জনতার বিপ্লবে হাজারো প্রাণ গেছে, আহত হয়েছেন হাজার হাজার এবং পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বহুজন। বিশেষ একটি প্রাণ সারাদেশের জনগণকে কাঁদিয়েছে, তরুণ শিক্ষার্থী আবু সাইদ। রংপুরের আবু সাইদ সহ আরও যারা শহীদ হয়েছেন সকলেই বীরের মর্যাদায় আমাদের অন্তরে আছেন। বিগত বছরগুলোতে নানান অনিয়মের কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস। এমন পরিস্থিতিতে সকলকে ধৈর্য্য ধরে সচেতনতার সাথে মিলেমিশে দেশের মঙ্গলের জন্য উত্তম কাজটি করতে হবে। বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আমাদেরকে বারবার বিজয়ের পথ দেখায়।।
[লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট]