ইকবাল কাগজী::
গত সোমাবার (২৫ নভেম্বর ২০২৪) একজনের ফেসবুক (মেটা) স্ট্যাটাসে বলা হয়েছে, “হাওরাঞ্চলকে নিজের মতো বাঁচতে দিন। উন্নয়নের নামে হাওরাঞ্চল মাফিয়াচক্রের কবলে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত। মাফিয়াচক্রের কবল থেকে হাওরাঞ্চলকে উদ্ধার করতে হবে। হাওরের চিরচেনা রূপে হাওরকে ফিরিয়ে আনতে হলে হাওরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।”
এই কথাটি এই একজনের অন্তরের কথা নয়, বরং সমগ্র হাওরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনের কথা। এই প্রবন্ধের মূল কথাটিও এই কথার সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। এসব সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে এই অঞ্চলের গণমাধ্যম, বিভিন্ন রাজনীতিক, সামাজিক সংগঠন। বিভিন্ন সময়ে কমবেশি তার প্রতিফলন ঘটেছে প্রকাশিত সংবাদ ও সংবাদপ্রতিবেদনে। কোনও স্থানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারালে সে-স্থানের উন্নয়ন প্রকারান্তরে অনুন্নয়নের নামান্তরে পর্যবসিত হয়।
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে প্রকৃতপ্রস্তাবে তাই ঘটেছে। এখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারানোর ভয়াবহ চিত্র প্রস্ফোটিত হয় যখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয় : ‘সুরমা নদী এখন মরা গাঙ’ (বাংলানিউজ ২৪ ॥ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ও ‘কুশিয়ারা নদী এখন মরা খাল’ (দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর ॥ ৬ এপ্রিল২০২৪)। এইসব প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার ঘটনা এখানকার উন্নয়ননীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
অপরদিকে উন্নয়নের কার্যক্রমের বদৌলতে অনুন্নয়ন ঘটে চলে নির্বিঘেœ। যেমন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়, ‘নজর খালি বাঁধ নির্মাণে মতবিরোধ’ (দৈনিক সমকাল ॥ ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। অথবা ‘দুর্নীতির চাদরে ঢাকা সুনামগঞ্জের ফসলরক্ষায় বাঁধ নির্মাণ’ (যমুনা টেলিভিশন ॥ ৪ এপ্রিল ২০২৪) ইত্যাদি। এ থেকে বোধোদয় হয় যে, গণমাধ্যম হাওরাঞ্চলে প্রচলিত উন্নয়ননীতির সমালোচনা করতে কখনওই কসুর করে নি। তাছাড়া হাওরাঞ্চলে উন্নয়নের নির্দেশিকা দিতে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন রাজনীতিক ও সামাজিক সংগঠন কখনওই পিছপা ছিলেন না। তাঁরা বিভিন্ন দাবি তুলেছেন সময়ে সময়ে। যেমন ‘সুরমা নদী অমলসীদ হতে ভৈরব পর্যন্ত খনন করতে হবে’ কিংবা ‘কুশিয়ারা নদী কালনী পর্যন্ত খনন করতে হবে’ অথবা ‘বন্যাসমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে নদী, উপনদী, শাখানদী ও খালবিল দখল মুক্ত করে খনন করতে হবে’। এই পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার একটি রাজনীতিক সংগঠন ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এর দাবি হলো : হাওরাঞ্চলের পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে নির্মাণকৃত সকল অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।
হাওরাঞ্চলের সমস্যার একটা অতীত ও বর্তমান আছে। সে দীর্ঘ ইতিহাস ব্যক্ত করার অবকাশ এখানে নেই। এই ইতিহাস বিভিন্ন তথাকথিত ‘উন্নয়নযজ্ঞ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আসলে সংক্ষেপে বলার বিষয় নয়, তবু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলতেই হবে। নিম্নে অতিসংক্ষেপে উন্নয়নের কতিপয় নমুনা উদ্ধৃত করে উন্নয়নের স্বরূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। কিন্তু বিষয়টা শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট সীমাকে অতিক্রম করে দাবি কিংবা প্রস্তাবাকারে প্রস্ফোটিত হয়েছে, যদিও লেখার নিয়মে তা অনাকাক্সিক্ষত, কিন্তু বিষয়সংশিষ্ট বলে একেবারে উপেক্ষনীয় নয়।
(ক) ১৯৫৪-৫৫ সালে উপর্যুপরি বারকয়েক বন্যা সংঘটিত হয়েছিল তৎকালের পূর্ববঙ্গে। তখন বন্যা প্রতিরোধকল্পে কুগ মিশন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে গঠিত ওয়াপদার (যা পরবর্তীতে ‘পাউবো’ নাম ধারণ করে) আওতায় গৃহীত কাজের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক প্রবাহকে উপেক্ষা করে রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেতু ও স্থাপনা নির্মাণ শুরু হয় এবং অধ্যাবধি এই প্রকৃতিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিজ্ঞান বিবর্জিত কার্যক্রম অব্যাহত আছে এবং বর্তমানে হাওরবাসীর গলার কাঁটা
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(খ) একদা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবাধ লুণ্ঠনের অংশ হিসাবে ভারতের বনাঞ্চলসহ পাহাড়ি অঞ্চলে নির্বিচারে বন উজাড়নের ফলে বাংলাদেশে বিনা বাধায় বন্যার ¯্রােতের সহিত বিপুল পরিমাণ পলি এসে জমা হওয়ার কারণে ক্রমে ক্রমে নদী-হাওরের তলদেশ ভরাট পড়েছে। তাছাড়া পাহাড়ের পাদদেশের বাংলাদেশের অংশের সমতলে ব্যাপক হারে জনবসতি গড়ে উঠার কারণে বন উজাড়ন হয়েছে বিপুলাকারে। ফলে উক্ত ভরাট প্রক্রিয়া আরও তরান্বিত হয়েছে।
(গ) কুগ মিশন পরিকল্পনার (১৯৬৪) অংশ হিসাবে হাওরাঞ্চলে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত শতশত স্লুইস গেইট বর্তমানে হাওরাঞ্চলের কৃষকের মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুগেল মেন নামের একজন আমেরিকান প্রকৗশলীর নামের স্মারক এই কুগ মিশন পরিকল্পনা।
(ঘ) বিগত শতকের আশির দশকে কুশিয়ারা ও কালনি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে উপেক্ষা করে করে এই দুই নদীর মিলনস্থলে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সেখানে গ্রাম-বাজার ইত্যাদি গড়ে উঠেছে এবং যথারীতি নদী মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে।
(ঙ) অভয়ারণ্য করার অজুহাতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাস্থল টাঙ্গুয়ার হাওর এখন কেবল ক্ষতবিক্ষত নয়, বরং বিপন্ন। অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত পর্যটন প্রসারের নামে টাঙ্গুয়া এখন পলিথিন, প্লাস্টিক, কাঁচের বোতল ইত্যাদির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, শুধু টাঙ্গুয়া নয় বরং সমগ্র হাওরাঞ্চলকে এখন কেউ কেউ বলছেন ‘জলের মরুভূমি’। যেখানে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী, পাখি ইত্যাদি প্রজাতি বিলুপ্তির শিকার হয়ে অধিকাংশ হারিয়ে গেছে এবং অবশিষ্টরা বিলুপ্তির অপেক্ষায় আছে।
(চ) জলবায়ু পরিবর্তের ফলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি হুমকিতে থাকা একটি দেশ । তাই জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় হাওরাঞ্চলের সকল উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা নতুনভাবে তৈরি করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়দি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। হাওরাঞ্চল রক্ষার পরিকল্পনাকে অতীতের মতো রক্ষার নামে মরণফাঁদ হয়ে উঠলে চলবে না।
(ছ) এক রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা পূরণে ইটনা-মিঠামইন সড়ক তৈরি করে সাক্ষাৎ যমদূতের হাতে হাওরবাসীকে তুলে দেওয়া হয়েছে। যার বাস্তব উদাহরণ ২০২২ সনের ভয়াবহ বন্যা।
(জ) দেশে দেদার উন্নয়নের কার্যক্রম চলেছে। কিন্তু উন্নয়নের টিকিটির দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে উন্নতিকে উপলক্ষ্য করে ইজারা দেওয়া হচ্ছে এবং ইজারার নামে ‘লুটপাটের লাইসেন্স’ দিয়ে বালিপাথর মহালে ড্রেজার-বোমা মেশিনযোগে প্রথমত প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনাশ, দ্বিতীয়ত হাজার হাজার বারকি শ্রমিকদেরকে বার করে দিয়ে হাওরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করাসহ ‘জাল যার জলা তার’ নীতির আড়ালে ইজারাদার নামক কায়েমি স্বার্থবাদীদেরকে টাকার কুমির বানিয়ে নব্যজমিদারে পর্যবসিত করা হয়েছে।
(ঝ) ইতোমধ্যে কাজেকীর্তিতে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্প মূলত হাওরাঞ্চললকে সম্পদ লুটপাটের মৃগয়াক্ষেত্রে পর্যবসিত করার উত্তম হাতিয়ার বিশেষ, যা কেবল জনগণের কাঁধে ঋণের বোঝা বাড়ায়। অথবা সুনামগঞ্জ শহরের উন্নয়নের নামে কামারখালসহ পাঁচটি খালকে কার্যত সংকীর্ণ পয়ঃপ্রণালী বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাওরবাসী এমন উন্নয়নের প্রত্যাশী নন।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে হাওরাঞ্চলের কৃষক ও কৃষিকে বাঁচাতে উন্নয়নকর্মের আড়ালে হাওরাঞ্চলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে নিয়েছে। এই আধিপত্যকে কেউ কেউ ‘মাফিয়া চক্রের একাধিপত্য’ কিংবা ‘কাঠামোগত সহিংসতার রাজত্ব’ বলে অভিহিত করছেন। আসলে অদ্যাবধি হাওরাঞ্চলে বাস্তবায়িত সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার করে তোলে উন্নয়নের অজুহাতে বিরল সম্পদপ্রাচুর্যের ভা-ার অপরূপ নিসর্গ নান্দিকতার স্বর্গ সমগ্র হাওরাঞ্চলকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। নদী খননকে উপেক্ষা করে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে বেশি করে উৎসাহী হয়ে এখানকার স্বাভাবিক জলপ্রবাহকে বিঘিœত করে প্রকারান্তরে হাওরের রক্তসঞ্চালনকে প্রায় রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং পরিণতিতে হাওর এখন মরতে বসেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, হাওরাঞ্চলের প্রচলিত উন্নয়ন পরিকল্পনা মূলত প্রতারণা ও মিথ্যার বেশাতিতে ভরপুর, যা জনগণের নয় লুটেরাদের স্বার্থরক্ষা করেছে মাত্র। জনগণের পক্ষ থেকে এই কারণে প্রচলিত উন্নয়নকর্মের মূল্যায়ন করে কার্যক্রম কিংবা পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করাসহ হাওরাঞ্চলে হাওর বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি করছি। এই দাবির কারণ হলো অতীতে হাওরকে নিয়ে যা কিছু হয়েছে তাকে যতোই উন্নয়ন নাম দেওয়া হোক না কেন, তা আসলে কাঠামোগত সহিংসতার আকারে দুষ্কর্ম ভিন্ন অন্য কীছু নয়। কিন্তু বলে রাখা ভালো যে : এই কমিশনটি হতে হবে হাওর, নদী, বন, পরিবেশ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, কৃষি ও প্রকৌশল ইত্যাদি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন।
পরিশেষে শুরুর কথায় ফিরে আসতে হচ্ছে। বলেছিলাম, ‘হাওরাঞ্চলকে নিজের মতো বাঁচতে দিন’। যেমন টাঙ্গুয়াকে তার হারানো যৌবন ফিরিয়ে দিতে হলে তাকে বিশ্রামে যেতে দিতে হবে, তাকে কোনও অজুহাত-প্রকারে উত্ত্যক্ত করা যাবে না। তবেই সে নিজের শক্তিতে নিজের হৃত যৌবনের পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে। হাওরেরও একটি নিজস্ব শক্তি আছে। সেই শক্তিকে ইতোমধ্যে উন্নয়নের নামে বিনাশ করা হয়েছে। এই বিনষ্ট শক্তির পুনর্জাগরণ চাই। খাল-বিল-নদী-নালা ইত্যাদি জলাধারের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে দিয়ে সে শক্তির পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখতে হবে।
অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা, স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। তবেই জেগে উঠবে হাওরাঞ্চলের প্রাণপ্রকৃতির ঘুমন্ত শক্তি। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত অপরিণামদর্শী প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করুন। হাওরে বিপন্ন প্রাণপ্রকৃতিকে লুটেরাদের হাত থেকে রক্ষা করুন। চাই কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বার্থরক্ষণবর্জিত কর্মপরিকল্পনা।