স্টাফ রিপোর্টার :: সুনামগঞ্জে ভুয়া দন্ত চিকিৎসকের ছড়াছড়ি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। চকচকে সাইন বোর্ড সাঁটিয়ে নিরীহ রোগীদের প্রতারিত করে আসছেন তারা। তাদের অপচিকিৎসার শিকার হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোগীদের জীবন। ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে গত ২০ অক্টোবর সুনামগঞ্জের ১৩ জন বিশেষজ্ঞ দন্ত চিকিৎসক সিভিল সার্জন এবং ৫ নভেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেছেন। একই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে আবেদনের অনুলিপিও দেয়া হয়েছে। অপরদিকে, গত ২০ অক্টোবর সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের পার্বতীপুর গ্রামের মো. সজিব মিয়া নামের এক রোগী অপচিকিৎসার শিকার হয়ে ভুয়া দন্ত চিকিৎসকদের অপচিকিৎসা বন্ধে জেলা সিভিল সার্জন বরাবরে আবেদন দিয়েছেন। তিনি আবেদনে উল্লেখ করেন, আমি জানতে পারি আমার এলাকায় হাবিবুর রহমান নামে একজন দন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন এবং তিনি নিয়মিত মঙ্গলকাটা বাজারে চেম্বার করেন। আমি দাঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে চিকিৎসার জন্য হাবিবুর রহমানের কাছে যাই। তিনি আমাকে দাঁতের চিকিৎসা দেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও দাঁত ভাল হয়নি। পরে জানতে পারি হাবিবুর রহমান রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার নন। তিনি দাঁতের ভুল চিকিৎসা করায় আমার রোগ ভাল হচ্ছে না। শারীরিকভাবে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং আর্থিকভাবেও আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সুনামগঞ্জের ১৩ জন বিশেষজ্ঞ দন্ত চিকিৎসক ডা. অসিত কুমার রায়, ডা. বনবীর রক্তিম, ডা. হোজাইফা মাহমুদ, ডা. ফাতেমাতুজ জোহুরা, ডা. বন্যা তালুকদার, ডা. নিশাত তাসনিম, ডা. সিরাজুল ইসলাম, ডা. দেলোয়ার হোসেন, ডা. নিশাত তাসনিম (২), ডা. জাহাঙ্গীর কবির, ডা. কাজী মেহেদী, ডা. ফৌজিয়া রহমান স্বাক্ষরিত জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন বরাবর অভিযোগে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) ২০১০ ধারা ২৮ (১) এবং মহামান্য হাইকোর্টের রায় মোতাবেক বিডিএস ডিগ্রী এবং বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনবিহীন কেউ নিজেকে দন্ত চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় বা দন্ত চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করতে পারবেন না। কেউ করলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপকার্য হবে একটি অপরাধ এবং এর জন্য তিনি ৩ (তিন) বৎসর কারাদ- অথবা ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। তারা আরও উল্লেখ করেন, এই আইন লঙ্ঘন করে কিছু সংখ্যক ভুয়া দন্ত চিকিৎসক অবৈধভাবে ডেন্টাল ক্লিনিক খুলে চিকিৎসা সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। এমনকি নিজেদের নামের আগে ডাক্তার বা ডেন্টিস্টসহ বেআইনি পদবী যুক্ত করে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করছেন। এতে সাধারণ মানুষ প্রকৃত চিকিৎসক ভেবে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। ১৩ জন বিশেষজ্ঞ দন্ত চিকিৎসক আবেদনে উল্লেখ করেন, অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া দন্ত চিকিৎসকরা আইনী জটিলতা এড়াতে ভিজিটিং কার্ড, প্রেসক্রিপশন প্যাড ও সাইনবোর্ডে রেজিস্ট্রার্ড দন্ত চিকিৎসকদের নাম ব্যবহার করে নিজেরাই অবৈধভাবে দন্ত চিকিৎসা পরিচালনা করে আসছে। যা আইনত দ-নীয় অপরাধ। তাদের এই বেআইনি কাজের কারণে রোগীরা যেমন অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। তেমনি মুখে জটিল সংক্রামক রোগ (যেমন: হেপাটাইটিস, এইডস ইত্যাদি) সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ভুক্তভোগী রোগীরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। তারা আরও উল্লেখ করেন, ভুয়া দন্ত চিকিৎসগণ স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাজে লাগিয়ে ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা পেতে বাধা প্রদান করছেন। প্রতিবাদ করলে তারা বৈধ রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারদের হুমকি-ধমকিসহ নানাভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু তারা নিজেদের চিকিৎসক দাবি করছে, তাই দন্ত চিকিৎসক সম্পর্কে রোগীদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। জনস্বার্থে ও ডেন্টাল পেশার সম্মান রক্ষার্থে সকল ভুয়া ‘ডেন্টিস্ট’ পদবী যুক্তদের অপচিকিৎসা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, সুনামগঞ্জের জেলা শহর ও উপজেলার হাট-বাজারে চেম্বার খুলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ভিজিটিং কার্ড, বিলবোর্ড বা সাইন বোর্ডে তাদের নাম ব্যবহার করে অন্তত ৫০ জন ভুয়া চিকিৎসক ‘ডেন্টিস্ট’ অথবা ইংরেজি দুই অক্ষরে সংক্ষেপে ‘ডিটি’ পদবী ব্যবহার করে ক্লিনিক্যাল ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এসব চেম্বারে সযতেœ দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন চিকিৎসার খরচ বাবদ ‘ট্রিটমেন্ট রেইট চার্ট’। যেমন দাঁতের স্কেলিং, ফিলিং, লাইট কিউর জিআই, অটো জিআই, টে¤পরারি ফিলিং, কমপ্লেইট ডেন্টাল, রুট ক্যানেল, ক্যাপসহ অন্তত ২২ ধরনের সেবার নাম ও খরচের হার সম্বলিত তালিকা। রেজিস্ট্রেশনবিহীন ভুয়া দন্ত চিকিৎসকেরা রোগীদের আকৃষ্ট করতে তাদের সাইনবোর্ডে নামের পিছনে পদবী হিসাবে কেউ কেউ বিএসসি ডেন্টাল (সিইউ), ডিডিটি ঢাকা, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্টেইট হেলথ ডিপার্টমেন্ট, ডিএমটি, ঢাকা, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম লিখে রেখেছেন। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ডিপ্লোমা ও বিএসসি টেকনিশিয়ান হয়েছেন। দাঁতের রোগী দানা মিয়া জানান, আমার দাঁতে শির শির করতো। পরে মঙ্গলকাটা বাজারে চিকিৎসা করাই। এরপরেও শির শির কমেনি। পলাশ চালবন্দের দাঁতের রোগী ইউনুস মিয়া জানান, আমার একটি দাঁতে ছিদ্র হয়েছিল। পরে ৪ হাজার টাকা খরচ দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। গত দুই সপ্তাহ আগে পলাশ বাজারে চিকিৎসা করানোর পর এখন মাথায় ও মুখে অন্যান্য সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন দাঁতে ব্যথা করে। মাথাও ব্যথা করে এবং মাথা ঘুরায়। তবে ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ানদের দেয়া সেবা প্রাপ্তির পক্ষে কেউ কেউ যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, শহরের বিশেষজ্ঞ ডেন্টিসদের কাছে চিকিৎসা নিতে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। শহরের আনাচে-কানাচে বা গ্রামের হাট-বাজারের ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ানদের কাছে চিকিৎসা নিলে অনেকটা কম খরচে সাধারণ দাঁতের রোগীরা সেবা নিতে পারেন। এখন তাদেরকে বন্ধ করে দিলে গরিব রোগীরা সেবা নিতে বিপাকে পড়বে। এ প্রসঙ্গে শহরের একজন ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ান বলেন, যখন এলাকায় ডেন্টিস্ট ছিলেন না, তখন তো শত শত রোগীকে সেবা দিয়েছি। এখন সুনামগঞ্জে ডেন্টিস্টদের সংখ্যা বাড়ছে, আগমন বাড়ছে। এখন আমাদের সেবার উপর নানা অভিযোগ আসছে। মঙ্গলকাটা বাজারের ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ান হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা ‘ডেন্টিস্ট’ পদবী ব্যবহার করছি। কারণ আমরা আদালতের রায় পেয়েছি। আসল কথা হলো, বছরের পর বছর আমি সেবা দিয়ে আসছি। কেউ কোনো দিন সেবার উপর অভিযোগ করেনি। এখন হঠাৎ আমার সেবার উপর অভিযোগ উঠেছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং সাজানো। তবে হাবিবুর রহমানের চেম্বারে সাইনবোর্ডে বিশেষজ্ঞ ডেন্টিস্ট ডা. ফিরোজ আহমদের নাম লিখে রাখা হয়েছে, যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, মঙ্গলকাটা বাজারে কোনো চিকিৎসা দিতে যাইনি আমি। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে কর্মরত ডেন্টাল সার্জন অসিত কুমার রায় জানান, ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ানরা যেভাবে তাদের নামের আগে ডেন্টিস্ট লিখেছেন তা স¤পূর্ণ অবৈধ। সার্জন ছাড়া রুট ক্যানেলের চিকিৎসা দেওয়ার এখতিয়ার নেই তাদের। ছোট ছোট কিছু কাজ তারা করতে পারেন। সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন জানান, বিডিএস বা এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন না করে নামের আগে ‘ডেন্টিস্ট’ লিখা যাবে না। এসব টেকনিশিয়ানরা কোন কাজগুলো করতে পারবে এটা নিদিষ্ট করা আছে। রুট ক্যানেলের মতো বড় কাজগুলো ডেন্টাল সার্জন ছাড়া করা যাবে না। তিনি আরও জানান, যে অভিযোগ আমার কাছে এসেছে, তা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বদলি হওয়ার কারণে তদন্ত কাজ একটু বিলম্ব হচ্ছে। তারপর বিষয়টি আমি দ্রুত খোঁজ নিয়ে দেখবো।