গত সোমবার (১৮ নভেম্বর ২০৪) সুনামগঞ্জের উন্নয়ন কীভাবে করা যায় সে বিষয়ে ‘উন্নয়ন ভাবনা’ নিয়ে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র রায় পোদ্দার। মঙ্গলবারের গণমাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়েছে, “সুনামগঞ্জে ‘উন্নয়ন ভাবনা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেছেন, ‘সুনামগঞ্জকে বন্যার ভয়াবহত থেকে রক্ষা করতে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। হাওরের কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে নদী খনন, দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাইমারি, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজের শিক্ষা-দীক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি সকল পর্যায়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।”
এইসব প্রস্তাবকে আমরা সমর্থন করি এবং বাস্তবায়ন হোক তা আমরা চাই ও চেয়ে এসেছি। যাঁরা এইসব অতীব প্রয়োজনীয় প্রস্তাব প্রাধান অতিথির বরাবরে পেশ করেছেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাই।
অভিজ্ঞমহলের ধারণা উপরোক্ত প্রস্তাবসমূহ গতানুগতিক তো বটেই নতুন কীছুও নয়। অনেক আগে থেকেই এমন সব ভাবনা ভেবে আসা হয়েছে, সরকারের দরবারে পেশ করা হয়েছে বিভিন্ন উৎস থেকে। প্রতিশ্রুতি প্রসবিত হয়েছে কিন্তু রাজনীতিক সমাজের চক্রান্তের কবলে পড়ে প্রতিশ্রুতিগুলো যথারীতি জটিলতার চোরাবালিতে তলিয়ে গেছে। বাস্তবায়িত হলেও তার লক্ষ্যকে অভিজাত শ্রেণির স্বার্থানুকূল করে তোলা হয়েছে, দেশের সাধারণ গরিব মেহনতি মানুষেরা সে উন্নয়নে উপকারভোগী হতে পারেনি। অর্থাৎ বর্তমান সমাজ সাংস্থিতিক পরিসরে কার্যত যা হওয়ার তাই হয়েছে। উন্নয়নের যতো কাজ হয়েছে সবগুলোতেই জনস্বার্থ অবহেলিত হয়েছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়েছে, ব্রিটিশরা যেমন করতো এবং পাকিস্তানিরা যেমন করেছে। কথিত আছে, পদ্মা সেতুর কাজে খরচ হয়েছে যা খরচ হওয়া উচিত তার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। এই বেশি টাকা তো জনগণেরই টাকা। কিন্তু ঘুরেফিরে চলে গেছে ধনী-দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক সমাজের ঝুলিতে, প্রকারান্তরে বিদেশে।
এমন অন্তঃসারশূন্য উন্নয়নের উদাহরণ আরও অনেক আছে, তালিকা অনেক লম্বা। সড়ক বেড়েছে, কিন্তু সড়কে পরিবহন ভাড়া বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল বেড়েছে, কিন্তু চিকিৎসা খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ, ঔষধের দাম বাড়তে কসুর করেনি।
প্রসূতির সিজার করে বাচ্চা বের করা হচ্ছে, এতে দেশের নাগরিক জন্মের প্রাথমিক খরচ দাঁড়িয়ে গেছে প্রায় অর্ধলক্ষ টাকারও বেশি। অথচ প্রসবের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক উপায় নিশ্চিত করা গেলে খরচ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, কিন্তু সেটা করতে গেলে তো বব্যসা হয় না। শিক্ষাকে ইতোমধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পণ্য করা হয়ে গেছে।
এবংবিধ উন্নয়নকে অভিজাত শ্রেণির কিংবা সম্পদশালীদের উন্নয়ন বলা গেলেও অনভিজাত কিংবা কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মেহনতি মানুষের উন্নয়ন বলা যায় না। এই অভিজাত শ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারি উন্নয়ন দেশে ব্যাপকাকারে বৈষম্য তৈরি করেছে এবং এই বৈষম্যই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছে। সুতরাং বর্তমানে উন্নয়নের অভিমুখ কী হওয়া উচিত, তার উত্তরে বলা যায় যে, উন্নয়ন ভাবনার পরিবর্তন দরকার। উন্নয়নকে হতে হবে বৈষম্যবিরোধী। উন্নয়ন ভাবনার ভেতরে বৈষম্যবিরোধিতার বীজ বপন করতে না পারলে উন্নয়ন যতই করা হোক না কেন সে-উন্নয়নের ফসল গিয়ে উঠবে ধনীদের গোলায়। শিক্ষা ও চিকিৎসাকে উচ্চমূল্যের পণ্য করে দেওয়ার পথ পরিক্রমণকারী উন্নয়নের সাফল্য কৃষকের শ্রমিকের ঘরে গিয়ে পৌঁছায় না, সেটা দেশের রাজনীতিক সমাজের স্বার্থরক্ষা করে বটে, কিন্তু জনসমাজের স্বার্থরক্ষা করে না। হাওরাঞ্চলে উন্নয়ন যতই করা হোক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সস্তা ও সহজ লভ্য করা না গেলে উন্নয়নের সুফল হাওরের জনসমাজের ঘরে গিয়ে পৌঁছবে না। স্কুল ঘর বানানো গেলেও শিক্ষার উচ্চমূল্যের কারণে সে- শিক্ষা ক্রয় করতে পরবে না হাওরের গরিব কৃষক ও মেহনতি মানুষেরা। সুতরাং স্কুল ঘরে ছাত্র পাওয়া যাবে না, তারা মাঠে-ময়দানে ধনীদের অধিকৃত আর্থনীতিক ক্ষেত্রে খেটে জীবন নির্বাহে তৎপর হবে। শেষ পর্যন্ত লাভ সেই ধনীদেরই, গরিবদের নয় এবং নয় বৈষম্য নিরসন, বরং বৃদ্ধি।
সুনামগঞ্জ হাওরের দেশ। হাওরের উন্নয়ন বাদ দিয়ে সুনামগঞ্জের উন্নয়নকে কল্পনাও করা যায় না। আজ থেকে দুই দশক আগে টাঙ্গুয়াকে রামসার সাইট ঘোষণা করে যতœ নেওয়ার ওসিলায় জলের মরুভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। সেখানে জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা হয়েছে সরকারি তত্ত্বাবধানে। সেখানে এখন মাছ-গাছ কীছুই নেই, কেবল জল, যে-জলে ফসল ফলে না, যাকে বলা যায় জলের বিরান ভূমি। হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ দেওয়া হয়েছে, নদী খনন কাজ হয়নি যেভাবে হওয়া উচিত সে-ভাবে ও সে-পরিমাণে। যাও হয়েছে সেগুলো হয়েছে উন্নয়নের স্বার্থে নয় বরং দুর্নীতি করে ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের দুরভিসন্ধিতে। অর্থাৎ বরাদ্দ মেরে খাওয়ার অনৈতিক নীতি অনুসরণ করে। তাই উন্নয়নের একটা লক্ষ্য থাকা চাই এবং লক্ষ্যটা হবে দেশের কম আয়রোজগারের মানুষের জীবনমানকে উচ্চতা দেওয়া। তা না করা গেলে উন্নয়ন প্রকারান্তরে অনুন্নয়নকেই ডেকে আনবে। যেমন সুনামগঞ্জের সুরমার উত্তর পাড়ে বালি-পাথর মহাল ইজারা দেওয়ার নীতি বাস্তবায়নের ব্যাপারটা উন্নয়নবিরোধী হয়ে পড়ে সেখানে ব্যাপক বেকারত্ব সৃষ্টি করে জনগোষ্ঠীকে উদ্বাস্তু করে দিয়েছে। এমন হলে সেটা উন্নয়ন হতে পারে না। সুতরাং সেখানে ইজারা নীতি বাতিল করা বা না-করার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ইজারাদারের উন্নতি নয়, সেটা হতে হবে সরকারের পর্যাপ্ত রাজস্ব প্রাপ্তি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করে বালুপাথর উত্তোলন ও সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, যাতে লক্ষ মানুষ বেকার না হয়ে যায়। তবেই সেটা হবে উন্নয়নের লক্ষ্যে ইজারা দেওয়া বা না- দেওয়ার খাতিরে উন্নয়নমুখী নীতি। কিন্তু যা-ই করা হোক রাজস্ব প্রাপ্তির বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে হবে, রাজস্ব আদায় করে অর্জিত রাজস্বের লক্ষ গুণের বেশি রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি না করে। যা বর্তমানে হচ্ছে। এমন হেলে তো উন্নয়নের প্রশ্নে সেটা অবশ্যই উন্নয়নবিরোধী একটি সরকারি কার্যক্রম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
উন্নয়নের একটি ভাবনা থাকা চাই যেমন, তেমনি তার থাকা চাই একটা লক্ষ্য। উপর্যুক্ত বাকবিস্তারের প্রেক্ষিতে বলা যায় আমাদের উন্নয়নের লক্ষ্যটি ঠিক করাই আছে, আর সেটি হলো রাজনীতিক সমাজ, যেখানে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষেরা অনুপস্থিত। এখুনে এর লক্ষ্যটিকে জনসমাজের দিকে ফিরিয়ে নিতে হবে, যেখানে আছেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মেহনতি মানুষ। তা না হলে বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনের শিকারে পরিণত হতে প্রস্তুত থাকতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়ছে সেই প্রবাদটির কথা, ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকূলে বাড়িছে সে’।