সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
চলতি ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোলের (ইসিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, এর সিংহভাগ সংক্রমণই ঘটেছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দেশে। সর্বোচ্চসংখ্যক সংক্রমণ দেখা গেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু, কলম্বিয়া ও প্যারাগুয়েতে। শুধু ব্রাজিলেই এ পর্যন্ত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৯৫ লাখের বেশি। আর্জেন্টিনা, পেরু, কলম্বিয়া ও প্যারাগুয়েতে সংক্রমণ সংখ্যা দুই থেকে ছয় লাখের মধ্যে।
এসব দেশে সংক্রমণ শনাক্ত বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে এরই মধ্যে তালিকার ওপরের দিকে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার ৮০০। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৬৭ জনের। সে অনুযায়ী, চলতি বছরের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যায় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ।
ডব্লিউএইচওর অধীন প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের (পিএএইচও) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ব্রাজিলে ৯৫ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ৫ হাজার ৩০৩ জন। এটি বিশ্বের মধ্যে একক কোনো দেশ হিসেবে ডেঙ্গুতে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আর্জেন্টিনা। দেশটিতে চলতি বছর ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৬২০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ৪০৮ জন। আক্রান্তের বিপরীতে মৃত্যুহার দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এরপরই ২ লাখ ৮৪ হাজার ১৭৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় প্যারাগুয়েতে। দেশটির ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ১২১ জন, যা মোট আক্রান্তের দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। কলম্বিয়ায় ২ লাখ ৬২ হাজার ৪৪০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে মৃত্যু হয় ১৩১ জনের। দেশটিতে মৃত্যুহার দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। পেরুতে মৃত্যুহার দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। দেশটিতে ২ লাখ ৬১ হাজার ৪১৫ জনের বিপরীতে মৃত্যু হয় ২৩৪ জনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে দেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস বহনকারী মশার উপদ্রব বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মশা নির্মূল ব্যবস্থার দুর্বলতা। এখন পর্যন্ত দেশে জাপানিজ এনকেফালাইটিস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া ও জিকা ভাইরাসের বাইরেও কিছু মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে রোগ নিয়ন্ত্রণ করে মৃত্যু কমানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মশাবাহিত এসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, এখন মৌসুম পরিবর্তনের সময়। সাধারণ জ্বর অনেকেরই হয়। সে হিসাব করে অনেকেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করান না বা সময়মতো চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন না। খুব খারাপ অবস্থায়ই ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। তবে শকে চলে যাওয়া রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা খুবই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। বাঁচা-মরার সম্ভাবনা সমান। অধিকাংশ রোগীই শেষ সময়ে এসে ভর্তি হয়। শেষ সময়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়ই রোগীকে আনা হয়। এসব কারণেই দেশে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেশি।
তিনি বলেন, আমরা চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকি। তবে কারো মধ্যে খারাপ কিছু থাকলে যেমন যিনি ডায়ালাইসিসে আছেন এমন কিডনি রোগীর ডেঙ্গু হলে খুব দ্রুতই অবস্থার অবনতি ঘটে। একইভাবে ডায়াবেটিস, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, ছোট বাচ্চা বা বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি খারাপ পর্যায়ে চলে যায়।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীরে অনেক বেশি জটিলতা তৈরি হলে চিকিৎসা দিয়েও অনেক সময় জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, রোগীর শরীরে তরল ব্যবস্থাপনা (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) এবং অণুচক্রিকা ব্যবস্থাপনা ঠিক হচ্ছে কিনা, বাংলাদেশে তার সঠিক চিত্র পাওয়া মুশকিল। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, মানুষের গতিশীলতা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ও অকার্যকর নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিরক্ষরতা ও সচেতনতার অভাবের মতো কারণে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও এতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিনিয়তই ডেঙ্গু পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখা যায়। দুই-তিনদিন ধরে দেখা যাচ্ছে যে কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বিভিন্ন এলাকা বা মহল্লায় ছোট ছোট পকেটে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। এ পকেটগুলোকে আগে চিহ্নিত করাটা খুবই জরুরি। এখন কোনো বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি হলে মশার প্রজননক্ষেত্র কোনো পকেটে সীমাবদ্ধ থাকে না। বৃষ্টি যেখানে হয় সেখানেই পানি জমে প্রজননক্ষেত্রে তৈরি হয়। ২৭ অক্টোবরের পর কোনো বৃষ্টি হয়নি। এখন বৃষ্টি ছাড়া যেখানে পানি জমা আছে সেসব পকেটে ডেঙ্গুবাহী মশা বা রোগী রয়েছে।
তিনি বলেন, এ পকেটগুলোকে চিহ্নিত করতে হলে যে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী রয়েছে, সেখানে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সঠিক ঠিকানা বের করা প্রয়োজন। সাধারণত যে কারো বাসা অথবা কর্মস্থল - এ দুটো জায়গা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এগুলো চিহ্নিত করে সেখান থেকেও ডেঙ্গু আক্রান্তদের খুঁজে বের করা দরকার। এভাবে পকেট ধরে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। হটস্পট ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো করা গেলে স্বল্প শক্তি প্রয়োগ করে ভালো ফলাফল আসে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী সুস্থতার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলবে এবং বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নি¤œভূমির দেশগুলোয় খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও নাজুক অবস্থানে রয়েছে উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, এর সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কালাজ্বর ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস ভাইরাস সংক্রমণের মতো ভেক্টরবাহিত রোগের পরিধি বাড়তে পারে। আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর পরিবর্তন হতে পারে।
ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত কারণে প্রতি বছর ৪০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মম-লীয় ও উপগ্রীষ্মম-লীয় জলবায়ুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এসব অঞ্চলের বেশির ভাগই শহর ও উপশহর। যদিও অনেক সংক্রমণ উপসর্গবিহীন বা শুধু হালকা অসুস্থতা তৈরি করে। তবে প্রায়ই এ ভাইরাসে সৃষ্ট জ্বর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ডেঙ্গুর জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা রোগীকে সুস্থ করে তোলে এবং মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।