সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পূর্ণ হয়েছে গতকাল শুক্রবার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৮ আগস্ট এই সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে নেয়। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রথম ভাষণে সরকারের লক্ষ্য নির্ধারণ করে বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ স¤পন্ন করে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। তবে গত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে নির্বাচনের রূপরেখা প্রকাশের জন্য চাপও ক্রমাগত বাড়ছে ড. ইউনূসের সরকারের ওপর।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনী রূপরেখা প্রত্যাশা করছে। তিন মাসেও কাক্সিক্ষত কোনো অগ্রগতি না থাকায় এ বিষয়ে দিন দিন দলগুলোর দাবি জোরালো হচ্ছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠক থেকে স্পষ্ট করেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচনী রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে। আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ দেওয়া না হলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কথা জানিয়েছে তারা।
গত ৫ নভেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র কাঠামোর কী কী সংস্কার করতে চায় এবং সেটা করতে কত দিন লাগবে, সেটা স্পষ্ট করে অবিলম্বে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করতে হবে। জনগণ দীর্ঘ সময় এই সরকারকে মানবে না। মির্জা আব্বাসের এই বক্তব্য দলের নীতিনির্ধারণী সভার মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ বলে জানান বিএনপির আরেক নেতা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ চাই। সরকারের উচিত হবে, রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন নিয়ে অ¯পষ্টতা কাটিয়ে তোলা।
৭ নভেম্বর উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় গত বুধবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাকে আমরা সবাই সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। তার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করে দেশের মানুষকে আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার। আমরা আশা করব, তিনি নির্বাচনের একটা পরিবেশ তৈরি করবেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবেন।
এর আগেও বিএনপি-জামায়াতসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল দুই দফায় সংলাপে অংশ নিয়ে ড. ইউনূসের কাছে নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে। দলগুলোর চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নির্বাচন সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। কিন্তু এরপরও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না আসায় রাজপথেই বারবার বিষয়টি দাবি আকারে উঠে আসছে। এমনকি এ দাবিতে মাঠে কর্মসূচি দেওয়ার আভাসও মিলছে।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গত ৩০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের জন্য সার্চ কমিটি গঠনের কথা জানানোর সময় বলেছিলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে দেশে নির্বাচনী অভিযাত্রা শুরু হয়ে গেছে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার ৭ নভেম্বরের আলোচনা সভায় বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যথানিয়মে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে।
তবে অন্য দিনের তুলনায় গতকাল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন, তাতে কিছুটা নমনীয়তার ছাপ পাওয়া যায়। অন্তর্বর্তী সরকার তিন মাসে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছে কি নাÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রাখছে তারা। ইতোমধ্যে তারা অনেক কাজ করেছে এবং করছে। আমরা সবাই সরকারকে সহযোগিতা করি। আশা করি, তারা উপযুক্ত সময়ে নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে।
এদিকে রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গঠিত ৬ সংস্কার কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে এরই মধ্যে গত ৪ নভেম্বর বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানান কমিশনের প্রধানরা। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী জানিয়েছেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কমিশনের সদস্যরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সফর করে জনসাধারণের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। এ ছাড়া জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডার প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শুরু হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন পেশ করবে জানানো হয়।
বৈঠকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি স¤পর্কে কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেন জানিয়েছেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে ১০টি সভা করেছে। পাশাপাশি অংশীজনদের সঙ্গে চারটি বৈঠক করেছে। জনসাধারণের মতামত চেয়ে একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করা হয়েছে; যা ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। কিছু আইন ও বিধি সংশোধনের প্রস্তাব এসেছে যেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। মব (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) নিয়ন্ত্রণে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করার প্রস্তাব নিয়েও কাজ চলছে। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর কিছু ধারা পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং তা পরিবর্তন করা হবে কি না সেটিও যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
বৈঠকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি স¤পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার। বৈঠকে জানানো হয়, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনুপস্থিত ভোটারদের জন্য পোস্টাল ব্যালট নিয়েও কাজ চলছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ভোটার তালিকা সমন্বয় করা হচ্ছে। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছে নির্বাচন সংস্কার কমিশন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অংশীদারদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।
তবে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা। এর জন্য কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যাতে নির্বাচনের আগে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়। তাই নির্বাচনমুখী সংস্কারকেই এখন প্রাধান্য দিতে হবে। রাষ্ট্রের সব সংস্কার দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তা ছাড়া মানুষও এখন ভোট দিতে উদগ্রীব। তাই সরকারের উচিত দ্রুত একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সব সংস্কার কার্যক্রম সমাপ্ত করতে গেলে এই সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে হবে, সেটা তো সম্ভব নয়। এমনটা হলে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। আমরা মনে করি, সরকার নির্বাচনের দিকেই এগোচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কিছু সংস্কার কার্যক্রম করতে হবে। তবে নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া উচিত।
তিনি মনে করেন, নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সংস্কার কার্যক্রম, নির্বাচনী রোডম্যাপ ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচনমুখী সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। এর জন্য নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা জরুরি।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না এ বিষয়ে বলেন, সরকারের উচিত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এর জন্য নির্বাচন কমিশন গঠন ও প্রশাসন তৈরি করতে হবে। এটা করতে দীর্ঘ সময় লাগার কথা নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসের মধ্যে বিগত এক মাসের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি না, তা নিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। একটি পত্রিকায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের এই বক্তব্য প্রকাশ হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি তার পদত্যাগ দাবি করে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। তারা বিএনপি-জামায়াতসহ গণঅ্যুত্থানের পক্ষে সমর্থন দেওয়া দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে মতবিনিময়ও করে। তবে বিএনপি রাষ্ট্রপতিকে সরানোর দাবিতে একমত পোষণ করেনি। তাদের মতে, এতে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে, যা নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। তবে ওই দুই সংঠনের দাবির মুখে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করে সরকার। ৭ মার্চ, ১৫ আগস্টসহ ৮টি জাতীয় দিবস বাতিল করা হয়। এ ছাড়া আগামী বছর রোজার ঈদে ৫ দিন, কোরবানির ঈদে ৬ দিন ও দুর্গাপূজায় ২ দিনের ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়।
দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অতিমাত্রায় চাপে রেখেছে বাজারদরের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। যদিও সরকারের নানা পদক্ষেপে কিছু পণ্যের দাম কমলেও তাতে এখনও স্বস্তি ফেরেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত সোমবার রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তর পরিদর্শন শেষে বলেন, আগের থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হয়েছে, কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া দরকার। এখন যদি বলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমনÑ জাস্ট সন্তোষজনক, কিন্তু এটা আরও ভালো হওয়া দরকার।
এ সময় তিনি আরও বলেন, ঢাকার প্রায় সব পুলিশকে আমরা চেঞ্জ করছি। তাদের অলিগলি চিনতেও সময় লাগবে। তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক গড়তে সময় লাগবে। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সামনের দিকে আরও হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সময়োপযোগী ও প্রশংসিত পদক্ষেপ হচ্ছে পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার ঘোষণা। পাশাপাশি নদীরক্ষায়ও বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশের কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুপারশপগুলোতে অবশ্য এ সিদ্ধান্ত কার্যকরা হয়েছে ১ অক্টোবর থেকে। নিষেধাজ্ঞার পুরোপুরি বাস্তবায়ন চোখে না পড়লেও পরিবেশবাদীরা আশা করছে, ধীরে ধীরে হলেও একসময় হয়তো দেশকে পলিথিনমুক্ত করা যাবে।