গত কয়েক মাস ধরে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন ও সবজিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজীয় পণ্যের সঙ্গে বাড়ছে চালের দাম। চালের দাম বৃদ্ধি পেলে স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। কারণ তাদের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করতে হয় চাল কিনতে। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের অন্যান্য পারিবারিক খরচ কমাতে হয়। এতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি ব্যাহত হয় লেখাপড়া ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকান্ড গত বছর ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় ভোক্তা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হন।
আমদানির পরিমাণও ছিল অনেক কম। কিন্তু এ বছর অনেক বেশি পরিমাণ চাল আমদানি করতে হবে। কারণ, সাম্প্রতিক বন্যা ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে আমনের উৎপাদন প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার টন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খাদ্য উদ্বৃত্ত ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোণা জেলায় উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির কারণে যথাক্রমে ১৪২৭৫, ৩৭১৫৫ ও ২৪ হাজার হেক্টর জমির আমন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে নোয়াখালীতে বন্যার কারণে আমনের ফলন ৩৫ ভাগ হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে জেলাটিতে আমনের উৎপাদন (চাল হিসেবে) ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৮৬ টন কম হতে পারে।
টিসিবির হিসাবে, বাজারে এখন মোটা চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। মাঝারি চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৩ টাকা এবং সরু চালের দাম ৭০ থেকে ৭২ টাকা। একই সরকারি সংস্থা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ৮ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অদ্যাবধি মোটা চালের সর্বনি¤œ দাম কেজিতে ২ টাকা, মাঝারি চাল কেজিতে ৪ টাকা এবং সরু চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ১২ টাকা।
ধান উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত নওগাঁতে প্রতি কেজি বিআর-২৮ চাল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, চিকন চাল জিরাশাইল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৮ থেকে ৭০ টাকা এবং কাটারিভোগ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭১ থেকে ৭২ টাকা। ব্যবসায়ীদের কথা গত এক মাসে ধানের দাম প্রতি মণে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে নওগাঁর বাজারে প্রতি মণ বিআর-২৮ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ১৪৫০ থেকে ১৪৮০ টাকা। আর প্রতি মণ কাটারিভোগ জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ১৫২০ থেকে ১৫৬০ টাকায়। ময়মনসিংহ মহানগরে মেছুয়া বাজার ঘুরে দেখা যায়, মোটা চাল প্রতি কেজি ৫৫ টাকা, মাঝারি বিআর-২৮ জাতের চাল ৬২ থেকে ৬৫ এবং চিকন কাটারিভোগ জাতের চাল ৭৪ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে খুচরা হিসেবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে দেশে। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তিন মৌসুমে ৪ কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে।
সম্প্রতি (২৮.১০.২০২৪) খাদ্য অধিদপ্তর এক চিঠিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জরুরি ভিত্তিতে ১০ লাখ টন চাল আমদানির কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। সরকারি হিসাবে, নিরাপত্তা মজুদ হিসাবে সরকারি গুদামে ১১ লাখ টন চাল থাকা উচিত। খাদ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সরকারি গুদামে চালের মজুদ ১০ লাখ টনের নিচে নেমে গেছে। এই মজুদ গত আগস্টের মাঝামাঝি ছিল ১৪ লাখ টন। চালের মূল্য ভোক্তা পর্যায়ে সহনশীল রাখতে হলে পণ্যটির মজুদ ও খোলাবাজারে বিক্রি উভয়ই বাড়াতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপত্তা মজুদ ও সম্ভাব্য ঘাটতি পূরণে কমপক্ষে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা প্রয়োজন।
২০১৭ সালে হাওরে আকস্মিক বন্যায় বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এক সপ্তাহে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়ে যায়। তৎকালীন সরকারকে চালের ঘাটতি পূরণে অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। এবারও যাতে ওই রকম অবস্থার সৃষ্টি না হয় সে জন্য সময়মতো চালের ঘাটতি পূরণে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকারের কাছে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলেছে, চাল আমদানি বাড়াতে হলে শুল্ক-কর পুরোপুরি তুলে দেওয়া দরকার। উল্লেখ্য, সরকার গত ২০ অক্টোবর এক দফায় চালের শুল্ক-কর ৬২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নির্ধারণ করলেও বেসরকারি পর্যায়ে বাড়েনি চালের আমদানি। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ১ জুলাই থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১৯৫৭ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৩৪.১৮ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ১৬৮ টন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ৪৮ টন চাল আমদানি হয়েছিল। চালের দাম সহনীয় রাখতে ও মজুদ বাড়াতে সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নিয়েছে। গত ১ নভেম্বর, এনবিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ এবং বিদ্যমান রেগুলেটরি শুল্ক ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের মূল্য কমবে ৯ টাকা ৬০ পয়সা। সমুদয় আমদানি শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে বাজারে চালের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং ভোক্তাপর্যায়ে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
আমদানির সঙ্গে সঙ্গে আগামী বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৫৩ ভাগ চাল উৎপাদন হয় বোরো মৌসুমে। আমন মৌসুমে উৎপাদন হয় শতকরা ৪০ এবং আউস মৌসুমে উৎপাদন হয় শতকরা ৭ ভাগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ টন। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয় ২ কোটি ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টন, আমন মৌসুমে উৎপাদন হয় ১ কোটি ৫৪ লাখ ২৬ হাজার ৪০০ টন এবং আউস মৌসুমে উৎপাদন হয় ২৯ লাখ ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন চাল।
তাই বোরো ধানের ফলন বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটকে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষকদের মধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ও ইনব্রিড জাতের ধান বীজের ব্যবহার বাড়াতে হবে। ধান চাষের আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে ধানের হেক্টরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি করতে হবে। সময় মতো পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমন কর্মকা- জোরদার করতে হবে।
বোরো মৌসুমে যাতে কৃষক সরকার নির্ধারিত দামে রাসায়নিক সার ক্রয় করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিগত সরকার ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম প্রতি কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি করে। ফলে কৃষক পর্যায়ে বর্তমানে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা, ডিএপি সারের দাম ১৬ টাকার পরিবর্তে ২১ টাকা, টিএসপি সারের দাম ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকা এবং এমওপি সারের দাম ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় এবং অনেক কৃষক বোরো ধান চাষে নিরুৎসাহিত পড়ে পড়েন। তাই এ ক্ষেত্রে কৃষকদের দাবি হলো ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম ৫ টাকা কমিয়ে আগের মতো করা হোক।
অনেকের মতে, বোরো ধানের উৎপাদন ১২ থেকে ১৫ লাখ টন বাড়ানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এ ক্ষেত্রে হাওর এলাকাসহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ওপর জোর দিতে হবে। বন্যায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে সরকারিভাবে বিনামূল্যে বোরো ধানের বীজ, সার ও বালাইনাশক বিতরণসহ নগদ সহায়তা প্রদান করতে হবে। বোরো ধান চাষের জন্য কৃষকদের সময়মতো প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ প্রদান করতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের কৃষকের প্রায় ৮৫ ভাগ হলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা হলেন কৃষির মূল চালিকাশক্তি। তারাই উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগ করে ফলন বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন এবং কৃষি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে তাদের অবদানও বড় কৃষকের চেয়ে অনেক বেশি। শস্য বন্ধকীকরণ চুক্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মধ্যে কৃষিঋণ বিতরণের নীতিমালা থাকলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষিঋণ প্রদানে অনীহা প্রকাশ করে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে এই অবস্থার এখনই অবসান হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এ ছাড়া বোরো ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্য মৌসুম চলাকালীন সময়ে সেচ কাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বোরো ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে ডিজেল সরবরাহ করতে হবে। কারণ, বোরো ধান শতভাগ সেচনির্ভর ফসল। ফসলটির উৎপাদনে অন্য মৌসুমের চেয়ে সার প্রয়োগ ও সেচ প্রদানে কৃষককে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়।
উৎপাদন খরচ গত বছরের চেয়ে প্রতি কেজিতে দুই থেকে আড়াই টাকা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার আসন্ন আমন মৌসুমে গতবারের চেয়ে প্রতি কেজি ধান-চালে সংগ্রহ মূল্য তিন টাকা বাড়িয়ে ১০ লাখ টন ধান, চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৪৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে পাঁচ লাখ টন সেদ্ধ চাল, ৪৬ টাকা কেজি দরে এক লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল এবং ৩৩ টাকা কেজি দরে সাড়ে তিন লাখ টন ধান সংগ্রহ করা হবে। ধান ও সেদ্ধ চাল সংগ্রহ অভিযান ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং আতপ সংগ্রহ অভিযান ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১০ মার্চ পর্যন্ত চলবে। এ ছাড়া সরকারি পর্যায়ে এ বছর ৫ লাখ টন চাল আমদানি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ৩ লাখ টন জি-টু-জি পদ্ধতিতে এবং বাকি ২ লাখ টন উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।
নানা রকম অসুবিধার কারণে কৃষক তাদের কষ্ট-ঘামে উৎপাদিত ধান সরকারি গুদামে সরবরাহ না করে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে খোলাবাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কী কী কারণে কৃষক সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করেন না, তা চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ, কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে আমরা যে যা কিছুই বলি না কেন, তারা বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধিতে মোটেই আগ্রহী হবেন না। ফলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
লেখক: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন