সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
রাষ্ট্র সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নির্বাচনের জন্য চাপ বাড়ছে। বিএনপি শুরুতে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইছে। সমমনা কয়েকটি দলও একই দাবি জানাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী সংস্কারে গুরুত্ব দিলেও বিলম্বিত নির্বাচন চায় না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দু-একটি ঘটনায় বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দলের অবস্থানের বদল হয়েছে। এর একটি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের উদ্যোগ। বিএনপি এর বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটির কোনো কোনো নেতা বলেছেন, এতে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে এবং নির্বাচন বিলম্বিত হবে। তাই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করলে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও আশ্বাস তৈরি হবে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার চাপের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার এমন আশ্বাস তৈরির পদক্ষেপ হিসেবে গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য দুই বিচারপতির সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি করেছে। একই দিন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, সরকার নির্বাচনের পথে অগ্রসর হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনের। ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। চলতি বছরের মধ্যেই কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। এরপর রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে সবার পরামর্শের ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগে সমর্থন দেয়। তবে বিএনপি শুরু থেকেই সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলে আসছে। তবে জামায়াতের অবস্থান কিছুটা ভিন্ন, দলটি সংস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে কবে নাগাদ নির্বাচন হতে পারে সে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আভাস দেওয়া হয়নি।
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার স¤পন্ন করে অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সেনাবাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতা থাকবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এটিকে সেনাপ্রধানের ‘ব্যক্তিগত মত’ বলে উল্লেখ করেন।
এরপর থেকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা ডালপালা মেলে। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবি করলে বিএনপি এতে আপত্তি তোলে। দলটি বলছে, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। এতে নির্বাচন বিলম্বিত হবে। ছাত্র নেতৃত্ব ও জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের দাবির বিষয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তবে বিএনপির অবস্থান বদলায়নি। এর পর থেকেই দলটি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জোরালো করে।
সরকারের সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিএনপি মনে করে, শুধু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারই যথেষ্ট। দলটি বলছে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে অন্য সংস্কারগুলো করা সম্ভব হবে। সাংবিধানিক বিধান এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে সাবধানতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে পরামর্শও দিয়েছে বিএনপি। এই অবস্থান থেকেই দলটি রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে এবং দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে বলে জানান বিএনপির নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত বুধবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর তাঁদের আস্থা রয়েছে এবং এই সরকার দ্রুত একটি নির্বাচন আয়োজন করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি বলেন, সরকার সময়ের সদ্ব্যবহার করবে বলে আশা করি। অন্য বিষয়গুলো এড়িয়ে নজর ইলেকশনের দিকে রাখলেই হবে - এটার কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা গণফোরাম, গণঅধিকার পরিষদের একাংশ ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠক সূত্র বলেছে, বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পৃথক এসব বৈঠকে ওই তিন দলের নেতারাও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে একমত হয়েছে। তাঁরা রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গেও একমত পোষণ করেন। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু উপস্থিত ছিলেন। গণফোরামের চেয়ারম্যান মোস্তফা মোহসীন মন্টু, কো-চেয়ারম্যান সুব্রত চৌধুরী; গণঅধিকার পরিষদের একাংশের আহ্বায়ক মিয়া মসিউজ্জামান, সদস্যসচিব ফারুক হাসান এবং এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, মহাসচিব মোমিনুল আমিনসহ দলগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
রাজনৈতিক কয়েকজন বিশ্লেষকও নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শুধু প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো স¤পন্ন করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁরা বলেছেন, দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা ও নির্বাচন স¤পর্কিত সংস্কার স¤পন্ন করার মাধ্যমে সরকার জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে সংকট গভীর হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, জনগণও নির্বাচন চায়। এ অবস্থায় রোডম্যাপ ঘোষণা করা হলে দলগুলো আশ্বস্ত হবে এবং দেরি হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।
বিএনপির সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। নির্বাচন বিলম্বিত হলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে মনে করেন বিএনপির সমমনা দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ স¤পাদক সাইফুল হক। তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর মতে, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। তবে এর আগে পুরো নির্বাচনীব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে।
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকা কিছু দলও দ্রুত নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ স¤পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টার বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, আশা করছি সরকারের কথা ও কাজের মিল থাকবে। প্রত্যাশা থাকবে নির্বাচন কমিশন গঠনের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।
জামায়াত সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এদিক থেকে বিএনপির সঙ্গে দলটির অবস্থানের কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। জামায়াত যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। তবে বিলম্বিত নির্বাচন চায় না। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, আমরাও নির্বাচন চাই। গত ১৫ বছর জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সামনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। আমরা সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছি, কিন্তু তাই বলে নির্বাচন বিলম্বিত হোক, তা চাই না।