সরকার পরিবর্তনের প্রায় তিন মাস হতে যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে খাতভিত্তিক সংস্কারের। কিন্তু সরকারের কাজকর্মে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসছে না। মানুষ সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে আছে জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে। সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই নাজুক অবস্থায়। অথচ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। সেই কাজটিই এখনো যথাযথভাবে করতে পারছে না তারা।
হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে। তাদের আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। তারপর থেকেই মানুষের জীবন ও সম্পদ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। পুলিশ বাহিনীর এই দুর্বলতার সুযোগে প্রকাশ্য দিবালোকে গণপিটুনিতে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, হামলা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ের ঘটনা বাড়তে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিভিন্ন মহল থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়টিকে এক নম্বর অগ্রাধিকার দেওয়ার দাবি ওঠে। মাসখানেক আগে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই পরিস্থিতির অবনতি করা যাবে না। যারা আইনশৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা করবে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’ এরপর অন্তত চার সপ্তাহ পার হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি, সাঁড়াশি অভিযানেরও আলামত নেই। বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনে ঢাকা শহরের কোনো কোনো এলাকা অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বেশিরভাগ থানা থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকার অভিযান চালিয়ে সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদের খুব সামান্য উদ্ধার করতে পেরেছে। এ পর্যন্ত সরকার পুলিশ বাহিনীকে পুরোপুরি কার্যকর করতে পারেনি। এমনকি প্রশাসনের ওপরও পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ আসেনি। এই সুযোগে অপরাধী চক্র বল্গাহীনভাবে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যারা রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা ছিল, এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি করছে। বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে। তাহলে এই দায় কার?
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, সাবেক সরকারের আমলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় অনেক স্থানে তারা আক্রান্ত হয়েছেন, আন্দোলনের সময় অন্তত ৪৪ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এসব ঘটনায় অনেক থানায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। আগের সরকারের সময়ে আলোচিত বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তা আর কাজেই যোগ দেননি। বেশ কিছু পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়েছে। সাবেক দুই আইজিপিসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মামলায় আটকও করা হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন। ফলে পুলিশকে পুরোপুরি সক্রিয় করা যাচ্ছে না। যদিও মানুষের কাছে এই যুক্তি খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে প্রায় তিন মাস হতে চলল। পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন ও কার্যকরী করার জন্য এটা কম সময় নয়। তাছাড়া বর্তমান সরকারের সময়ে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি ও সেনাসদস্যরাও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে আছেন। সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাও। এরপরও খুন, ছিনতাই, ডাকাতির মতো গুরুতর অপরাধমূলক ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। বিপুল লোকবলের পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রশ্ন আসে, এত থানা-পুলিশ, বিশেষ সংস্থার এত লোকজন তাহলে কী করে? কোন এলাকায় কোন অপরাধী চক্র সক্রিয়, তার সব তথ্য তাদের নখদর্পণে থাকার কথা। তাহলে কীভাবে একের পর এক নৃশংস হত্যাকা-, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণের ঘটনা ঘটছে?
‘অপরাধী যে-ই হোক, কাউকে ছাড়া দেওয়া হবে না’ এটা যে কথার কথা নয়, সরকারের কাজকর্মে তা প্রমাণ করতে হবে। অভিযুক্তের রাজনৈতিক পরিচয় গৌণ। প্রতিটি ঘটনায় প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, তাহলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। মূলত হত্যা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা থেকে সমাজ ও দেশের মানুষকে সুরক্ষার জন্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্ভব ঘটেছে। মানুষ তাই সংগত কারণেই এ বাহিনীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা যথাযথভাবে পরিপালন হওয়া উচিত। বলার অপেক্ষা রাখে না, নৃশংস হত্যাকা-সহ অন্যান্য অপরাধের মাত্রা কমাতে হলে প্রথমে এর পেছনে থাকা কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। খুনসহ অন্যান্য অপরাধের ঘটনা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হত্যাকা-সহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ কমে আসবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জবাবদিহি প্রতিষ্ঠাও জরুরি। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার ক্ষেত্রে জবাবদিহি অন্যতম শর্ত। ঘটনা ঘটার পর তৎপর হওয়ার মধ্যে কৃতিত্ব নেই। ঘটনা যাতে না ঘটে, এমন পরিবেশ তৈরি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যতম দায়িত্ব। অপরাধমূলক তৎপরতা রোধে সতর্ক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এর প্রতিকারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া দরকার। নইলে কিন্তু সরকারকেই জবাবদিহি করতে হবে।
যেসব সমাজ বা দেশে বিচার আছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ আছে, সেসব সমাজে অপরাধের মাত্রা খুবই কম। যখনই কোনো সমাজে বিচার ও নিয়ন্ত্রণের অভাব হয়, তখনই সে সমাজে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। জনজীবনের শান্তি বিঘিœত হয়। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতির নামে অপরাধী-লালন প্রক্রিয়া চলছে। সাত খুনের আসামিকে জেলখানা থেকে বের করে রাজনৈতিক নেতা বানানো, ক্ষমতা বদলের পর খুনের মামলাসহ গণহারে মামলা প্রত্যাহার, দলীয় কর্মীদের অপরাধকে দেখেও না দেখা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দলীয়করণ ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়াসহ আরও অনেক অনিয়মের ফলেই দেশে আজ এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সংস্কার ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়, যা মোটেই কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে বিশ্বের কাছে দেশ ইমেজ সংকটে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্য ম্লান হয়ে যেতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা এ সরকার নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে দুজন তরুণ প্রতিনিধিও আছেন। তারা পরিস্থিতির আলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন বলেই প্রত্যাশা করি।
লেখক: কলামিস্ট ও লেখক