গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর ২০২৪) সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও ধোপাজান-চলতি নদীর বালুপাথর মহাল থেকে বালুপাথর লুট বন্ধ করা ও তার প্রতিকারার্থে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির সম্মুখিন করার বিষয়ে প্রশাসনের তরফে অংশীজনদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা হয়ে গেছে। তাতে মহাল দুটিতে প্রাকৃতিক সম্পদ অবৈধ উপায়ে ও অবাধে লুণ্ঠনের বিষয়ে বিভিন্নজন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। এইসব বক্তব্যে বালুপাথর লুণ্ঠন সমস্যার প্রতিকারের পথ উন্মোচিত হয়েছে এবং প্রশাসনের তরফে প্রতিকার ও সমাধান করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রতিকারের বিষয়ে সুনামগঞ্জ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম ছদরুল বলেন, “বারকি শ্রমিকরা পরিবেশবান্ধব উপায়ে যাদুকাটা ও ধোপাজান নদী থেকে বালু উত্তোলন করতে চায়। ইজারা ব্যবস্থার বাতিল চায় এবং রাজস্ব দিয়ে বালু পাথর উত্তোলন করতে চায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হাতের সাহায্যে বালু উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাফিয়া চক্রের হাত থেকে মহাল উদ্ধার করতে হবে। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন ও রিপোর্ট শে^তপত্র আকারে জনস্মুখে প্রকাশ করতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দুষ্ট লোকজন মহালের দিকে চোখ তুলে তাকাতে না পারে।”
এবংবিধ বক্তব্য ও তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পর জানি না, সমস্যার সমাধান হবে কি না। যদিও জানি, আমাদের দেশে আমজনতার প্রত্যাশারা রাজনীতিক সমাজের প্রতিশ্রুতির চোরাবালিতে ডুবে গিয়ে ‘আশায় নৈরাশা’র পুনরোৎপাদন করে মাত্র।
সাধারণ জনগণের এই ‘আশায় নৈরাশা’র ভেতরে ‘আশায় বসতি’ করার নিয়তি নির্ধারণের মতো যাপিত জীবনব্যাপী ঘটনাকে প-িতেরা অভিহিত করেন ‘কাঠামোগত সহিংসতা’র একধরণের প্রচ্ছন্ন প্রকাশ বলে।
সহিংসতা সাধারণত হয়ে থাকে শারীরিক ও মানসিক। এই সহিংসতা যদি ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমাজকে আক্রমণ করে ব্যাপক হয়ে উঠে, যা জনগণের নির্দিষ্ট একটি অংশের ক্রমাগত ক্ষতি করে চলে এবং সমর্থন পেয়ে থাকে বিদ্যমান রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ব্যবস্থাসহ সে-ব্যবস্থার পরিসরে গজানো বিভিন্ন সংস্থা থেকে এবং পরিণতিতে একটি গোটা পদ্ধতিগত ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়, তাহলে সেটা আর সহিংসতা থাকে না হয়ে উঠে কাঠামোগত সহিংতা। এটা অনেকটা অনির্দিষ্ট, ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর, স্বতন্ত্র ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সংঘটিত হয় না। এই কাঠামোগত সহিংসতার স্বরূপ উন্মোচিত হয় যখন এই মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী জিহান জুবায়ের বলেন, “প্রকাশ্যে দিবালোকে অবৈধভাবে ধোপাজান থেকে বালু উত্তোলনে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সরাসরি জড়িত। ডিবির সাবেক ওসি আমিনুল ইসলাম নিজের তদারকিতে বালু উত্তোলনে সহযোগিতা করেছেন। পুলিশ সুপারকে বিষয়টি আমরা অবহিত করেছি, কিন্তু এরপরও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছিল” অথবা যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “আমি ডিসি মহোদয়কে ফোন করে বলেছিলাম জাদুকাটা নদী থেকে অবৈধভাবে বালুপাথর উত্তোলন করে পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। বিপ্লবী সরকার কোন রাজস্ব পাচ্ছে না। উনি বললেন, তুমি এসপি মহোদয়কে ফোন করো, আমি জানি না। আমি বললাম, আপনার দায়িত্ব কি? উনি বললেন, আমি এসপিকে বলেছি, উনি শোনেন না। আমি বললাম আমি কথাটা নোট করেছি। উনি বললেন, করো গিয়ে।”
এই মতবিনিময় সভার বক্তারা বালুমহালে কাঠামোগত সহিংসতার আধিপত্য বিরাজমানতার বিষয়ে পর্যাপ্ত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। সেজন্য তাঁদের ধন্যবাদ। এতে প্রমাণিত হয়েছে, বালুপাথরখেকো লুটেরাগণ প্রশাসনিক সহযোগিতার জোরেই বালু কিংবা পাথর লুটের অপকর্মটি করতে সমর্থ্য হন এবং সমাজের সর্বত্র চাঁদাবাজ ও উঠাইবাজের সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকে, প্রকারান্তরে ব্যক্তি কিংবা সমাজকে ক্রমাগতভাবে ক্ষতবিক্ষত করে।
পরিশেষে বলি, সুনামগঞ্জের সুরমার উত্তরে বালুমহালে কাঠামোগত সহিংসতার আধিপত্য চলছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদে সাধারণ মানুষের অধিকার ছিনতাই করে জনসমাজ ও প্রকৃতির ক্ষতি করা হচ্ছে। মানুষ কাজ করে খাওয়ার অধিকার হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং নদীতীরের জনপদ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। বালুপাথর লুটেরাদের এই আধিপত্যের বিপরীতে জনতার কিংবা বিশেষ করে বারকিশ্রমিকদের আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলে উত্তরের জনপদের মানুষের জীবন-জীবিকা বিঘিœত হবেই। ঠেকানো যাবে না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জনতাকে নিতেই হবে।