স্টাফ রিপোর্টার ::
সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন নদীতে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী (এনডিসি)। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার আ.ফ.ম আনোয়ার হোসেন খান পিপিএম, ৬১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, অধিনায়ক মেজর মহিউদ্দিন ফারুকী, ২৮ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল একেএম জাকারিয়া কবির।
মতবিনিময় সভার শুরুতে ধোপাজান-চলতি নদী বিষয়ে নানা তথ্য ও স্থিরচিত্র উপস্থাপন করেন এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ছাব্বির আহমেদ আকুঞ্জি। মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সমর কুমার পাল।
সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষা আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাড. শাহেদা আক্তার, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. শেরেনূর আলী, দৈনিক সুনামগঞ্জের ডাক সম্পাদক ও প্রকাশক এবং সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যক্ষ শেরগুল আহমদ, দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরের স¤পাদক পংকজ দে, জামায়াত নেতা সিরাজুল ইসলাম অলি, সাংবাদিক লতিফুর রহমান রাজু, সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি একেএম আবু নাসার, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ জেলা কমিটির সাধারণ স¤পাদক সাইফুল আলম সদরুল, শিক্ষক হাবিবুর রহমান, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, আব্দুল্লাহ আল গালিব, স্থানীয় সংগঠক এনডি উসমান গণী, জিহান জুবায়ের, বালু শ্রমিক আব্দুর রশীদ, নাসির মিয়া, সাহেদ মিয়া, পরিবেশকর্মী শওকত আলী প্রমুখ।
সভায় বক্তারা বলেন, পুলিশের সদিচ্ছা থাকলে অবৈধভাবে বালু-পাথর লুট বন্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারাও এসব লুটপাটে জড়িত ছিল। তাই বিগত তিন মাস লুটপাট বন্ধ করতে পারেনি। পুলিশের লোকজন প্রতিদিন ধোপাজান-চলতি নদী থেকে ৪০-৫০ টি নৌকা আটক করতো এবং একটি নৌকা ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়েও দিতো। এভাবে ৫ আগস্টের পর থেকে বেশি পরিমাণে লুটপাট হয়ে আসছিল। এসব লুটপাটে সাংবাদিক নামধারী কিছু লোক জড়িত ছিল। বালু ও পাথরের ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে পুলিশ, ডিবি ও অসাধু সাংবাদিক নিয়ে এই অবৈধ কাজ করতো। তারা বলেন, লুটপাট বন্ধ করতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে আবেদন করেও কোনো লাভ হয়নি। লুটপাট চলমান ছিল।
বক্তারা আরও বলেন, এখনও সুনামগঞ্জে কিছু কর্মকর্তা বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের হয়ে কাজ করছেন। যার কারণে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা ও ধোপাজান চলতি নদীতে বালু-পাথর প্রায় দেড়শত কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে। আজ এই মতবিনিময় সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, বিআইডব্লিউটিএ থেকে সুরমা নদীরঘাট লিজ নিয়ে চাঁদা তোলে বিভিন্ন স্থানের খালে ও নদে। সুরমা ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়ন পরিষদের নামেও চাঁদা উত্তোলন করা হয় ধোপাজান-চলতি নদীতে। একইভাবে উপজেলা পরিষদের নামে এবং পৌরসভার নামেও চাঁদা উত্তোলন করে চাঁদাবাজরা। সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের টুকেরবাজার নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা লুটপাট ও চাঁদাবাজিতে জড়িত আছে বলে অনেকে বক্তব্য রাখেন।
বক্তারা বলেন, শহর পুলিশ ফাঁড়ির ঘাটে প্রতিদিন অর্ধশত বাল্কহেড আটক থাকে। আবার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এসময় সাংবাদিক পরিচয়ে কিছু অসাধু লোক জড়িত থাকে পুলিশের সাথে। এসব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান বক্তারা।
বক্তারা আরও বলেন, স্বচ্ছ ব্যক্তি দ্বারা কমিটি গঠন করে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অভিযুক্ত হয়েছেন, তাদেরকে ওই কমিটিতে রাখা যাবে না। বক্তারা ফ্যাসিবাদী সরকারের লোকদের খুঁজে বের করে তাদেরকে প্রতিহত করে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সভা চলাকালে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধীরা লুটপাটে পুলিশের সম্পৃক্ততা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে থাকেন। তখন মিলনায়তনে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়।
সভায় আগত একাধিক ব্যক্তি জানান, সদর থানার পুলিশ ও ডিবি পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারা প্রতিদিন অন্তত শতাধিক নৌকা ধরা ও ছাড়ার মহোৎসবে মেতে উঠেছিলেন দীর্ঘ তিন মাস যাবত। তারা কিছু নামধারী সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে চলতেন। সন্ধ্যারাতেই তারা চলে যেতেন ধোপাজান-চলতি নদীতে। অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা রাত ১০টায় ফিরে শহরের বিভিন্ন বিকাশের দোকানে লক্ষ লক্ষ টাকা নিজের এলাকায় পাঠিয়ে দিতেন। অসাধু সাংবাদিকরা থাকতেন সারারাত।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ধোপাজান-চলতি নদীতে বালু-পাথর লুটপাট বন্ধে আমি যথাযথ দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, আমি অল্পদিন হয় সুনামগঞ্জে এসেছি। এসেই সবকিছু জানতে পারিনি। যা জানতে পেরেছি, বিজিবি’র কো¤পানি কমান্ডারকে নিয়ে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছি। তাদের সহযোগিতায় অনেক বড় অভিযান করেছি। আমাকে সবাই সহযোগিতা করলে আরও অভিযান পরিচালনা করে বালুখেকোদের দমন করা যাবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ২৮ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল একেএম জাকারিয়া কবির বলেন, গত ২২ আগস্ট আমরা বড় অভিযান করে ড্রেজার ও নৌকা আটক করেছি। তিনি বলেন, যাদুকাটা ও ধোপাজান নদীতে ড্রেজার চালনা করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে। এসব তথ্য স্থানীয়রা দিয়েছিলেন। তাদের সহযোগিতায় এই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার আ.ফ.ম আনোয়ার হোসেন খান পিপিএম বলেন, আমি মাত্র দেড় মাস হয় সুনামগঞ্জে এসেছি। ধোপাজান-চলতি নদীতে যখনই বালু-পাথর লুট হচ্ছে জেনেছি, তখনই আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। এই অবৈধ কাজে যে পুলিশ কর্মকর্তারা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ডিবি’র ইন্সপেক্টরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠিয়েছি। অন্যান্য পুলিশ অফিসারকে বিভিন্ন জেলায় বদলি করেছি। তিনি বলেন, বাবুল ও নাজিম নামে দুই বালুখেকোকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করেছি। তিনি আরও বলেন, আপনারা আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে দ্রুত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা সম্ভব হবে।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী (এনডিসি) বলেন, যারা জাতির স¤পদ লুটপাট করছে, তাদের বিরুদ্ধে এক সাথে লড়তে হবে। এরা শক্তিশালী, হিং¯্র ও ভয়ংকর। বালু ও পাথরখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বালু-পাথরখেকোরা লিজ নেয় এক জায়গা। কিন্তু বালু-পাথর উত্তোলন করে বিশাল এলাকা নিয়ে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে। যেভাবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও এসিড নিক্ষেপ প্রতিরোধ করা হয়েছিল। এদেরকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তিনি বলেন, যারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে বাল-পাথর লুট করছে, তাদেরকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, যারা বালু-পাথর লুটপাটের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।