কারাগারের উদ্ভব হয়েছে সমাজের জন্য ক্ষতিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ লোকদের নির্দিষ্ট মেয়াদে আটকে রাখার জন্য। তাই কেউ জেলে আছে শুনলেই শৈশবে মনে হতো লোকটা বুঝি চোর-ডাকাত বা খুনি। তখন অবশ্য বড়রা ভিন্ন রকম এক বন্দির কথা বলতেন। লক্ষ করতাম তেমন বন্দিদের নামও নিতেন শ্রদ্ধাভরে। তারা ছিলেন রাজবন্দি।
তখন রাজবন্দি হওয়া ছিল গর্বের ব্যাপার। ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাইকে জীবনে একাধিকবার তেমন বন্দি হতে হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষের পক্ষে বিশেষ কোনো আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতার হতেন। লড়াইয়ের ময়দানে তাদের অনুপস্থিতি রাজনৈতিক অনুসারীরা প্রতিনিয়ত অনুভব করত। তাই তাদের মুক্তির ক্ষণে আমজনতা স্বাগত জানাতে জেলগেটে হাজির হতো।
সম্প্রতি বহু ডাকসাইটে নেতা গ্রেফতার হচ্ছেন। তাদের প্রতি নিজেদের কর্মীরা সেই ধরনের টান অনুভব করছেন? খুব সম্ভবত না। কারণ এখনকার রাজনীতি জনগণের শক্তিতে হয় না। বরং বিশেষ নেতার আশীর্বাদ বা লবিংয়ের ফলে নেতা হয়। ফলে আগের দিনের রাজনীতিবিদরা মৃত্যুর পরও দীর্ঘকাল জনগণের হৃদয়ে বেঁচে থাকতেন। কিন্তু বর্তমান নেতারা বেঁচে থেকেও কেমন যেন জীবন্মৃত হয়ে পড়ছেন, তাই না?
আসলে সেকালে নেতা উঠে আসতেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। তারা এলাকার যেকোনো বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতেন। এলাকাবাসীর সংকটে তাদের আলাদা করে ডাকতে হতো না। বরং নিজ থেকেই ছুটে যেতেন এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ তৎপর হতেন। এভাবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ক্রমেই বৃহৎ পরিসরে যেতেন। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাই পরবর্তীকালে জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
নেতৃত্ব সৃষ্টির এমন ধারা যুগের পর যুগ চালু ছিল। তখন নেতা ও কর্মীদের আত্মার সম্পর্ক থাকত। সম্ভাবনাময় নেতারা দলের আদর্শ বাস্তবায়নে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যেতেন। তাদের সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার আশায়। এভাবে বহু ধনী পরিবারের সন্তান রাজনীতি করতে গিয়ে পৈতৃক স¤পদ বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকে খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি আর চটি পায়ে সারা দিন দলের আদর্শের জন্য কাজ করতেন।
এমন ধারার রাজনীতিতে যার যত বেশি জনসম্পৃক্ততা থাকত দল তাকেই তত বেশি মূল্যায়ন করত। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তার মতামত প্রাধান্য পেত। কারণ মাঠের অবস্থা তিনি ভালো জানতেন; জনমত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে ধারাটি একেবারে উল্টে গেছে। এখন নেতা হতে জনসমর্থন লাগে না। বরং বিপুল পরিমাণ অর্থ আর জায়গামতো যোগাযোগ থাকলে যে কেউ রাতারাতি নেতা হয়ে যান।
যুগের পর যুগ দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে হুট করে জনবিচ্ছিন্নদের দলীয় মনোনয়ন দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। দলের হাইকমান্ড ঠিক কোন যোগ্যতায় তাদের পছন্দ করে সে ব্যাখ্যাও কর্মীদের কাছে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। এভাবে হঠাৎ চাপিয়ে দেয়া প্রার্থীর সংখ্যা রাজনৈতিক দলগুলোয় ক্রমেই বাড়ছিল। ফলে দলের তথাকথিত নেতা ও কর্মীদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এমনকি গ্রুপিং ও দলীয় কোন্দল ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
পেশাজীবী সংগঠনগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। তারা সহকর্মী বা অধস্তনদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে নেতা হয়। কিন্তু সারাক্ষণ মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বার্থরক্ষায় তৎপর থাকে। কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষায় দরকষাকষি নয় বরং কর্তাদের দালাল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে।
ঠিক তেমনিভাবে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব আসার কথা ছিল ছাত্রদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু সেখানেও ছাত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা বিবেচ্য বিষয় থাকেনি। বরং কেন্দ্রের নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তারা একেকটা পদ লাভ করে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, ছাত্রনেতা টাকা দিয়ে নেতা হবে কেন? আর এ কাজ করার মাধ্যমে কি তারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বা কমিশন খাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে যান না?
এভাবে বিগত বছরগুলোয় প্রায় সব স্তরের নেতারা হয়েছেন জনবিচ্ছিন্ন। তাদের গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা মুখ্য নয়। তারা ওপরের দিকের নেতাদের কাছে ধর্ণা দেন। তারাও বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে নেতা ঠিক করে দেন। সে কারণে কথিত নেতা নিজ এলাকায় বা কর্মস্থলে গিয়ে সাধারণদের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না।
যেকোনো রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় ভালো করতে চায়। কারণ এতে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রান্তিক পর্যায়ে দলের অবস্থানও সুসংহত হয়। পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আগের দিনে এমন সব নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকত না। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিজ যোগ্যতায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হতো। এতে জনসম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই বিজয়ী হতেন। এমন চর্চায় নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটত। রাজনৈতিক নেতারা সবসময় জনগণের পাশে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন।
তাছাড়া ওই নির্বাচনগুলোয় দলীয় প্রতীক না থাকায় প্রশাসন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করত। প্রত্যেক প্রার্থীর এজেন্ট ও কর্মীরা কারচুপি ঠেকাতে কেন্দ্রগুলোয় তৎপর থাকতেন। ফলে নির্বাচন হতো দারুণ উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হয়েছে দলীয় প্রতীক প্রবর্তনের মাধ্যমে। কারণ আগের দিনে প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে জনবিচ্ছিন্ন, অসৎ, দুর্নীতিবাজ প্রার্থীরা প্রাথমিক পর্যায়েই বাদ পড়ত। কিন্তু দলীয় প্রতীক বরাদ্দের কারণে প্রার্থীদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয়েছে নির্বাসিত। প্রার্থীরা ছুটতে থাকে ওপরের দিকের নেতাদের কাছে। টাকার বস্তা ও লবিং দুটো দিয়েই মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। স্থানীয় প্রশাসনও সেই প্রার্থীকে জেতাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এভাবে মাঠপর্যায়ের রাজনীতিতে যোগ্য লোকেরা নির্বাচিত হওয়ার দ্বার একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়।
বলতে পারেন বেশকিছু জায়গায় তো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করে। আসলে সেগুলো হয় অন্য কারণে। সেই এলাকার কোনো প্রভাবশালী নেতার লবিংয়ে হয়তো একজন মনোনয়ন লাভ করেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের আরেক মন্ত্রী বা এমপির নিজস্ব প্রার্থী রয়েছেন। ফলে তিনি সব ক্ষমতা ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নিজ (স্বতন্ত্র) প্রার্থীকে বের করে এনেছেন! এমন চর্চায় দলের মধ্যে কোন্দল বেড়েছে। দীর্ঘমেয়াদে দল ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের মনোনয়ন বাণিজ্য ঠিক রাখার স্বার্থে তারা দলের ক্ষতি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। এভাবে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। তাই ভোটের রাজনীতিতে মানুষের আস্থা ফেরাতে সব ধরনের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা জরুরি। এমনকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। এটা হলে বড় দলগুলোর শত শত কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্য রাতারাতি বন্ধ হবে। প্রার্থীরা কেন্দ্রের নেতাদের পেছনে না ছুটে নিজ নির্বাচনী এলাকায় পড়ে থাকবেন। সুষ্ঠু নির্বাচনে যিনি জিতে আসবেন তিনি সংসদ সদস্য হবেন। এমপি নির্বাচন করবে জনগণ, দলের প্রধান নন।
এমনটা হলে নির্বাচন উপলক্ষে ‘বিনিয়োগ’ ভাবনা হ্রাস পাবে। কোটি কোটি টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনতে হবে না। নির্বাচিত হওয়ার পর সেই টাকা তোলার চিন্তাও অগ্রাধিকার পাবে না। তাছাড়া পরের বার নির্বাচিত হতে চাইলে দুর্নীতি করার ভাবনায়ও লাগাম দিতে হবে। সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে যারা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে চান শুধু তারাই টিকে থাকবেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে সুযোগসন্ধানী দুধের মাছিরা ছুটে পালাবে।
একটি নির্বাচনী এলাকায় যারা নিজেদের জনপ্রিয় মনে করেন তারা সবাই প্রার্থী হবেন। তারা নিজ যোগ্যতা দিয়ে নির্বাচনে পাস করে আসবেন। তারপর যে রাজনৈতিক দলের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য লিখিতভাবে সমর্থন জানাবেন তারা সরকার গঠন করবে। এমনটা হলে সরকার গঠনের পর দলের প্রধান বেপরোয়া হওয়ার সাহস পাবেন না। সব সদস্যকে নিজ কার্যক্রম দিয়ে আস্থায় রাখার বোধ সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করবে।
তাছাড়া এর মাধ্যমে বহুল আলোচিত ৭০ ধারাও অকার্যকর হয়ে যাবে। কারণ একজন এমপি সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও সেই সরকারের সব প্রস্তাবে অন্ধভাবে সমর্থন করতে বাধ্য থাকবেন না। উত্থাপিত বিল পছন্দ না হলে সেই সদস্যের বিপক্ষে ভোট দেবেন। এতে জনবিরোধী বিল সংসদে উত্থাপনের প্রবণতা কমবে। এমনকি উত্থাপিত হলেও তা পাস হবে না।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন বন্ধ করা গেলে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রতিটি পর্যায়ে সংসদ সদস্যদের কাছে জবাবদিহিতার প্রশ্নটি মাথায় রাখবে। সংসদ সদস্যরা একইভাবে নিজ এলাকার জনগণের কথা স্মরণ রাখবেন। তখন একক কোনো ব্যক্তির সুপার পাওয়ার হওয়ার চিন্তা মাথায় আসবে না। বরং সামষ্টিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করার প্রবণতা বাড়বে। এতে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাচর্চায় ভারসাম্য আসবে।
[ড. মো. আব্দুল হামিদ : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও ‘মস্তিষ্কের মালিকানা’ বইয়ের লেখক]