অনুপ তালুকদার::
বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন বসবাস করে সেখানে তাঁদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা সাড়ম্বরে পালিত হয়। বছরে দুইবার দুর্গাপূজার প্রথা প্রচলিত আছে। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয় দুর্গাপূজা এবং চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে শারদীয় দুর্গাপূজা ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আমাদের এই দেশে সর্বজনীনভাবে পালন করা হয়। তবে বাসন্তী দুর্গাপূজাও প্রতি বছর করা হয়ে থাকে যার অধিকাংশই পারিবারিক মন্দিরে উদযাপিত হয়।
বসন্ত কালে সুরথ নামে এক ধর্মপ্রাণ রাজা দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। রাজা সুরথ রাজ ধর্মানুসারে প্রজাদিগকে সন্তানের ন্যায় প্রতিপালন করতেন। একবার তিনি যবনদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন। রাজা সুরথ স্বীয় রাজধানীতে অবস্থানকালে দুষ্ট দুরাত্মা অমাত্যগণ শত্রুদের সাথে চক্রান্ত করে তাঁর ধনভা-ার ও সৈন্যদের শত্রুর দখলে নিয়ে যায়। রাজ্যচ্যুত হয়ে রাজা সুরথ মৃগ শিকারের ছলে একাকী অশ্বারোহণে গভীর জঙ্গলে গিয়ে দেখতে পেলেন সশিষ্য মেধা ঋষির আশ্রম। ঋষি রাজাকে দেখে যৎপরোনাস্তি খুশি হয়ে সমাদরে আশ্রমের ভিতর নিয়ে গেলেন। কিছুদিনপর রাজা মমতাকৃষ্ট চিত্তে পরিত্যক্ত রাজধানী, ধনভা-ার, প্রজাগণ, অমাত্যবর্গ, হস্তি - অশ্বাদির বিষয়ে ভাবছিলেন। এমন সময় আশ্রমের নিকটে শোকগ্রস্ত দুর্মনা বৈশ্য সমাধি নামক এক ব্যক্তির সাথে দেখা হলো। সুরথের আন্তরিক সম্ভাষণ মুগ্ধ হয়ে বৈশ্য সমাধি বললেন, “অসাধু স্ত্রী পুত্রগণ তার ধনস¤পদ আত্মসাৎ করায় মনের দুঃখে তিনি বনে এসেছেন। বনবাসী হয়েও স্ত্রী পুত্রগণ ও ধনস¤পদের কথা ভুলতে পারছেন না।”
অতঃপর তারা দুজনেই তাদের হৃতগৌরব ফিরে পেতে মেধা ঋষির দ্বারস্থ হলেন। ঋষির উপদেশ শুনে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নদীতীরে মহামায়া দুর্গার স্তুতিপূর্বক পূজা অর্চনা স¤পন্ন করেন। বাসন্তী পূজার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে নারায়ণ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলেছেন- “পুরা স্তুতা সা গোলকে কৃষ্ণেন পরমাত্মণা সং পূজ্য মধু মাসে চ প্রীতেন রাসমন্ডলে।। [ব্রহ্মবৈবর্ত পূরাণ, শ্রী সীতারাম বৈদিক মহাবিদ্যালয়, কলিকাতা, ১৩৯০, প্রকৃতি খ- ৬৬।২]
অর্থাৎ পূর্বকালে গোলকে রাসম-লে বসন্তকালে পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক সেই দেবী প্রথমে স্তুতা হন। এরপর দ্বিতীয়বার মধুকৈটভ যুদ্ধে বিষ্ণু কর্তৃক এবং তৃতীয়বার সেইকালে প্রাণসঙ্কট উপস্থিত হলে ব্রহ্মা কর্তৃক স্তুতা হন।
শরৎকালে দেবীপূজা সম্বন্ধে কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে, “মহিষাসুর বধের জন্য দেবগণ কর্তৃক স্তুতা হয়ে দেবী কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে দশভুজা দুর্গারূপে আবির্ভূত হন। এই শরৎকালেই শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দুর্গাপূজা করেন। যদিও শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা সম্বন্ধে বাল্মিকী রামায়ণ, অধ্যাত্ম রামায়ণ, তুলসী দাসকৃত রামচরিতমানস প্রভৃতি প্রসিদ্ধ গ্রন্থে কোনো উল্লেখ নেই। বঙ্গদেশে সুপ্রসিদ্ধ কৃত্তিবাসী রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার সুন্দর ও বিস্তৃত বর্ণনা অতিভক্তিভরে সুললিত ছন্দে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পূজার উপকরণাদি পরিবেশ বর্ণনায় বাংলার আঙ্গিনা কবির মানসপটে প্রতিভাত হয়েছে।
শ্রীরামচন্দ্র যখন রাবণকে বধ করার জন্য চিন্তিত তখন দেবতাদের পরামর্শে ব্রহ্মা শ্রীরাম সমীপে উপস্থিত হয়ে ষষ্ঠী কল্পে বোধনের বিধান দিলেন- বিধাতা কহেন সার শুন বিধি দেই তার করে ষষ্ঠী কল্পেতে বোধন। [ কৃত্তিবাসী রামায়ণ, পৃষ্ঠা ৩৮১]
শারদীয় দুর্গাপূজায় ষষ্ঠীর সন্ধ্যাকালে বেল গাছের মূলে দেবীর বোধন করা হয়। বোধন শব্দের অর্থ হলো জাগরণ। পুরাণ অনুসারে পৃথিবীর এক বছর হচ্ছে স্বর্গের এক দিনের সমান। সূর্যের উত্তরায়ণ (মাঘ থেকে আষাঢ় মাস) হচ্ছে দেবতাদের দিন এবং দক্ষিণায়ন (শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস) হচ্ছে দেবতাদের রাত্রিকাল। দক্ষিণায়নে দেবতাগণ নিদ্রায় থাকেন বিধায় এ সময়ে পূজা করার বিধান নাই। তাই শরৎকাল দেবীর আরাধনার উপযুক্ত সময় নয়। অকালে তাঁর পূজা করতে হলে তাঁকে জাগরিত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটি বোধন নামে পরিচিত। দেবী দুর্গার কৃপা লাভের আশায় এই অসময়ে রামচন্দ্র দেবীর পূজা করেছিলেন বলে শারদীয় দুর্গাপূজাকে দেবীর অকাল বোধনও বলা হয়ে থাকে। শ্রীরামচন্দ্র ম্লান করে বেদ বিধি মতে সপ্তমী পূজা সম্পন্ন করেন। “গীত নাট চ-ীপাঠে দিবা অবসান” - এর পরদিন রঘুনাথ অষ্টমী পূজা সমাপন করলেন। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হলো।
অবশেষে নবমী তিথিতে বিশাল পূজার আয়োজন করা হয়। কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণে বর্ণনা করেন- নবমীতে রঘুপতি পুজি বারে ভগবতী উদযোগ করিলা ফল ফুল বেদ বিধি মত আনিলাম সামগ্রী কত কপিগণ যোগাইছে ফুল।। [পৃ-৩৮২]
অশোক, কাঞ্চন, জবা, মল্লিকা, মালতী, পলাশ,বকুল, অতসী, অপরাজিতা, চম্পক, নাগেশ্বর ইত্যাদি বঙ্গদেশে সুপরিচিত নানাবিধ পুস্পর সমাহার কৃত্তিবাস সাজিয়ে দিয়েছেন। পরম আনন্দে শ্রীরামচন্দ্র তার ভাই লক্ষ্মণ সহিত সভক্তিতে দেবীর অর্চনা করছেন। দেবীর দর্শন না পেয়ে ভাতৃদ্বয় ব্যাকুল হন। তখন বিভীষণ কাতর কণ্ঠে বলেন-- তুষিতে চীরে এই করহ বিধান অষ্টোত্তর শত নীলোৎপল করে দান। দেবের দুর্লভ পুস্প তথা যথা নাই তুষ্ট হবেন ভগবতী শুনহ গোসাঞি।। [পৃ-৩৮৩] এ কথা শুনে হনুমান দেবীদহ থেকে একশো আটটি নীলপদ্ম আনলেন। শ্রীরামচন্দ্রও এক এক করে সেই নীলপদ্ম দেবীর চরণে ভক্তিভরে সমর্পণ করছেন। কিন্তু একশো সাতটি পদ্ম দানের পর ঘটলো বিপত্তি। ক্রমে পদ্ম সব দিলেন রাঘব রাম জগত গোসাঞি শেষেতে বিয়োগ হৈল অত্র যোগ এক পদ্ম মিলে নাই।।[পৃ-৩৮৩] শ্রীরামচন্দ্র পড়লেন শঙ্কায়। এদিকে হনুমান জানিয়েছে দেবী দহে আর কোনো নীলপদ্ম অবশিষ্ট নেই। বহু স্তুতিগাথার পর “কাতরে কহেন রাম দেবী-পদতলে”। অনেক খেদোক্তি প্রকাশের পর তিনি সংকল্প করেন- ভাবিতে ভাবিতে রাম করিলেন মনে
নীল কমলাক্ষ মোরে বলে সর্ব্বজনে।।
যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোৎপল
সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়া সকল।। [পৃ-৩৮৬]
এভাবেই শ্রীরাম যখন নিজ চক্ষু শরাঘাতে উৎপাটন করার উদ্যোগ নিলেন তখনই দেবী আবির্ভূত হয়ে নিবারন করলেন--
কি কর কি কর প্রভূ জগত গোসাঞি
পূর্ণ হৈল চক্ষু উপড়িয়া কার্য্য নাই।।[পৃষ্ঠা ৩৮৬]
কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণে নীলপদ্মের কাহিনীটা নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে। প-িত কৃত্তিবাস দশমীতে পূজা শেষে দেবীবিসর্জন করে শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের উদ্দেশ্যে যুদ্ধযাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে অন্যান্য পুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজা মোটামুটি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং সেখানে নবমীতে রাবণবধ এবং দশমীতে বিজয়োৎসব হয়। পুরাণে পুরাণে কিছু মতভেদ থাকলেও শ্রীরামচন্দ্রের দ্বারা শারদীয় দুর্গাপূজা স¤পন্ন হয়েছিল বিধায় অকালে হলেও সর্বক্ষেত্রে এই পূজা প্রাধান্য পেয়েছে।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়।