সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
লতা বেগম (ছদ্মনাম)। একদিন দেখতে পান তার ফেসবুক আইডির নাম ব্যবহার করে একটি আইডি এবং আরও একটি ভুয়া ফেসবুক আইডিতে তার ছবিগুলোকে অশ্লীল ছবির সঙ্গে যুক্ত করে ওই আইডি দুটি থেকে পোস্ট করছে। কিছুদিনের মধ্যেই আইডি দুটি থেকে হয়রানির মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। অভিযুক্ত ব্যক্তি শুধু ভুক্তভোগীর ছবিই না, তার আত্মীয়ের ছবির সঙ্গে ভুক্তভোগীর ছবি ও তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর যুক্ত করে আপত্তিকর ক্যাপশনসহ পোস্ট করে। এতে তার মান-সম্মান হুমকি পড়ে। এর পর লতা যোগাযোগ করেন পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে। একই সঙ্গে নিকটস্থ থানায় একটি জিডি করেন।
পরে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে থানায় একটি মামলা করেন। লতা বেগমের অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযুক্তদের শনাক্ত করে এবং দুজনকে গ্রেপ্তার করে। অনুসন্ধানে খায়রুজ্জামান ডালিম এবং রাসেল মোল্লা নামে দুজনের নাম বেরিয়ে আসে। জানা যায়, খায়রুজ্জামান ডালিম তার প্রতিবেশী। ভুক্তভোগীর পরিবারের সঙ্গে তার জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ ছিল এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি ভুক্তভোগীকে তার সঙ্গে প্রেমের স¤পর্ক স্থাপনের জন্য অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। ভুক্তভোগী রাজি না হওয়ায় অপর অভিযুক্ত রাসেলের সহায়তায় অপরাধমূলক কাজটি করে।
কলেজপড়–য়া তরুণী রুবি আক্তার (ছদ্মনাম)। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়। হ্যাকার তার আইডি থেকে তার ভাইয়ের আইডিতে মেসেজ দিয়ে আইডি ফেরত প্রদানের জন্য তাকে টাকা পাঠাতে বলে। রুবি হ্যাকারকে টাকা পাঠালে পুনরায় টাকা চায় এবং বিভিন্ন অশ্লীল ছবির সঙ্গে ভুক্তভোগীর ছবি যুক্ত করে আপত্তিকর ক্যাপশনে পোস্ট করে। এ বিষয়ে রুবি নিকটস্থ থানায় জিডি করেন। থানা থেকে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ভুক্তভোগীর কাছ থেকে তথ্যপ্রমাণ পর্যালোচনা করে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন প্রযুক্তির সহায়তায় অভিযুক্তকে শনাক্ত করে এবং এমরানকে গ্রেপ্তার করে।
জানা যায়, এমরান ভুক্তভোগী রুবির গ্রামের বাজারের দোকানদার। আইডি হ্যাক হওয়ার এক সপ্তাহ আগে রুবি তার কাছে মোবাইল ফোন ঠিক করতে দেয়। এমরান ওই সময়ে রুবির আইডিতে তার নিজের ইমেইল আইডি যুক্ত করে এবং পরে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর পর রুবির স্বজনের কাছে টাকা দাবি করে। এভাবে শুধু লতা বা রুবি নয়। সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে অসংখ্য নারী। গত প্রায় চার বছরে ৩৯ হাজার ৩০১ জন নারী সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ডক্সিং (ক্ষতি করার উদ্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা) ও ব্লাকমেইলের শিকার হচ্ছে বেশি। ডিজিটাল প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার যেমন আশীর্বাদ তেমনি তা সহজলভ্য হওয়ায় অপব্যবহারও কম নয়। সময়ের পরিবর্তনে সাইবার অপরাধেরও নতুন ধরন দেখা যাচ্ছে। সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করা পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন বলছে, নারীদের কাছ থেকে এখন ডক্সিং ও ব্লাকমেলের অভিযোগ মিলছে বেশি।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ হাজার ৬৪৫ জন নারীর অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে সেবাপ্রত্যাশীরা পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে ৬০ হাজার ৮০৮টি ম্যাসেজ, ৮৬ হাজার ১৮২টি ফোন এবং ৯৭৭টি মেইল দিয়েছে। অভিযোগের মধ্যে ৭ হাজার একটি ছিল ডক্সিংয়ের অভিযোগ; যা মোট অভিযোগের ৪১ শতাংশ। ব্লাকমেলের অভিযোগ এসেছে ৩ হাজার ১০৬টি; যা মোট অভিযোগের ১৮ শতাংশ। আইডি হ্যাকের সংখ্যাও কম নয়। এ সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে ২ হাজার ৯৮৬টি; যা মোট অভিযোগের ১৭ শতাংশ। নারীরা যে ধরনের অপরাধের শিকার হয়ে থাকেন সেই অনুযায়ী সাইবার অপরাধকে আটটি ধাপ করা হয়েছে। প্রথমটি হলো ডক্সিং। এর মাধ্যমে ভুক্তভোগীর ছবি, মোবাইল নম্বর, বাসার ঠিকানা, এনআইডি বা যে কোনো পরিচিতিমূলক তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (প্রকৃত বা এডিট করে) পোস্ট করে, কমেন্ট করে, কাউকে মেসেজের মাধ্যমে পাঠিয়ে হয়রানি করা হয়। এর পরের ধাপ ইমপারসোনেশন। ভুক্তভোগীর ছবি, নাম বা যেকোনো পরিচিতিমূলক তথ্য ব্যবহার করে ভুক্তভোগী সেজে ছদ্মবেশে হয়রানি করা হলো ইমপারসোনেশন। এর পরের ধাপ আইডি হ্যাক। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো আইডি বা ইমেইল এড্রেস বা অন্য কোনোভাবে ডিজিটাল তথ্য হ্যাক করে অপরাধ করা হয়। এর পর রয়েছে ব্ল্যাকমেলিং। এটি হচ্ছে টাকা দাবি করা বা আপত্তিকর ছবি বা আপত্তিকর অবস্থায় ভিডিও কলে আসতে বলা বা আপত্তিকর ভাষায় চ্যাট করার জন্য ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি দেওয়া। পরের অবস্থানে সাইবার বুলিং। এতে ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন পোস্টে বা মেসেজের মাধ্যমে আপত্তিকর ভাষায় কমেন্ট করা, মেসেজ করা, পর্নোগ্রাফিক ছবি বা ভিডিও পাঠানো। এর পর আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও ছড়ানো। এটি হচ্ছে ভুক্তভোগীর আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে বা মেসেজ-ইমেইলের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।
সপ্তমটি হচ্ছে মোবাইল হ্যারেসমেন্ট। এতে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে কল বা এসএমএস দিয়ে হয়রানি করা হয়। এ ছাড়া উপরোক্ত কোনো অপরাধের তালিকায় পড়ে না এমন অন্যান্য অভিযোগও রয়েছে অষ্টম ধাপে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, নারীর জন্য সাইবার ¯েপস নিরাপদ রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় শুধু নারীদের জন্য পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন নামে আমাদের একটি উইং কাজ করছে। সাইবার ¯েপসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ আমাদের সামনে আসে। কোনোটি বেশি ঘটে, আবার কোনোটি কম। তবে আমাদের কাছে যে অভিযোগই আসে তা যাচাইবাছাই শেষে সত্যতা পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। - বাংলাদেশ প্রতিদিন