গণমাধ্যমে সংবাদপ্রতিবেদনের শিরোনাম করা হয়েছে ‘লুটপাটের অভয়ারণ্যে যাদুকাটা-ধোপাজান’। এটা কোনও নতুন কথা নয়, বহু দিন আগেকার কথা। মনে করা হয় : এই মহালগুলোতে বালু-পাথরখেকো চক্রের (সিন্ডিকেটের) আধিপত্য চলতেই থাকবে, অনন্তকাল না হলেও অন্তত বর্তমান রাজনীতিক-সামাজিক অর্থব্যবস্থার পরিসরে গড়ে ওঠা প্রশাসনিক ব্যবস্থা যতো দিন টিকে থাকবে ততোদিন পর্যন্ত। তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০০৯ সালে যাদুকাটা নদীতে ড্রেজার-বোমা মেশিন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে একটি মামলা এবং ধোপাজান নদীতে ৭৪৩১/১৩ একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। মহামান্য আদালত উল্লেখিত দুইটি নদীতে ড্রেজার-বোমা মেশিন বন্ধের নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু বালু-পাথরখেকোরা উচ্চ আদালতের নির্দেশ আমান্য করে নদী দুইটিতে ড্রেজার-বোমার ব্যবহার অব্যাহত রাখে। পরিবেশকর্মীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সরজমিন পরিদর্শন করে ধোপাজান বালু মহাল বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়। নানা আন্দোলন-সংগ্রাম ও আইনি লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে মহাল থেকে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কার্যত বন্ধ হয় না। কার্যত আইনের বাণী বালু মহালগুলোতে অকার্যকর হয়ে নীরবে-নিভৃতে ঘুরপাক খায় আর একসময় প্রতিশ্রুতির চোরাবালিতে ডুবে মরে এবং নদীর প্রস্থ ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়, পরিণতিতে নদীভাঙনে ঘরবাড়ি, ফসলী জমি, বনভূমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়া চলতেই থাকে, প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধির সঙ্গে জনভোগান্তিও বৃদ্ধি পেতেই থাকে।
জানা কথা, সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। এখানে সম্পদের সকল উৎস নির্দ্বিধায় ও নির্বিঘেœ দখল করা হবে এবং লুটপাট চালানো হবে অবাধে, প্রশাসনের নাকের ডগায়। সম্পদের ভাগবাটোয়ারা চলবে উপর থেকে নিচ তলার নির্দিষ্ট স্তরপর্যায়ে, রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত। ধনকুবেরী আধিপত্য চলবে সর্বত্র, এমনকি প্রশাসনের ভেতরেও এবং প্রকারান্তরে দুর্নীতিনির্ভর হয়ে পড়বে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি, প্রশাসন অর্থনীতিতে অধিপতি শ্রেণির গোলামে পর্যবসিত হবে। পুঁজিবাদ পেকে গিয়ে যখন সা¤্রাজ্যবাদে পর্যবসিত হয় তখন মরমর সেই পুঁজিবাদ আরও ক’দিন বেঁচে থাকতে এইভাবেই আধিপত্য বিস্তার করার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এই ব্যাধির ব্যতিক্রিমহীন প্রকাশ ঘটছে বালুমহালগুলোতে। অর্থাৎ প্রকৃতপ্রস্তাবে যাদুকাটা-ধোপাজান বালুমহালে সেই আধিপত্যেরই প্রকাশ ঘটেছে। বিশেষ শ্রেণিচক্র (সিন্ডিকেট) সেখানে আধিপত্য বিস্তার করে মহালগুলোতে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে, বিগত কয়েক দশক যাবৎ।
প্রশাসনের কাছে এই আধিপত্য উৎখাতের দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, প্রশাসন জনগণের ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিষ্ঠিত নিজের প্রভুত্বকে বিসর্জন না দিয়ে এ আধিপত্যকে উৎখাত করতে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের আসল সমস্যা শ্রেণি প্রাধান্য থেকে উদ্ভূত শ্রেণি বৈষম্য। দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলা এইসব শ্রেণিসমূহের সকলেই ইতোমধ্যে এই দেশে প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীতান্ত্রিক (অলিগার্কিক) আধিপত্যের পুরোহিত। তারা রাষ্ট্রের ভেতরে এক ইঞ্চি পরিমিত জায়গায়ও জনগণের ক্ষমতায়ন কার্যকর হওয়ার জন্যে ছেড়ে দেবেন না। এখনও পর্যন্ত পুঁজির পতাকাতলে জনশাসনের ইতিহাস অন্তত তাই বলছে। মনে রাখতে হবে : এই দেশে কোনও গণতন্ত্র নেই এবং কখনও ছিল না, শুধু ভোটাধিকার প্রাপ্তির বিবেচনায় নয়, সামাজিক ধনসম্পদ বণ্টনসহ অন্যান্য ক্ষেত্র-খাতেও গোষ্ঠীতান্ত্রিক আধিপত্যের বিপরীতে গণতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আসলে গোষ্ঠীতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতিভুদের (দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ব্যসায়ী, আমলা এইসব শ্রেণিসমূহের) জীবনের একমাত্র আদর্শ বৈষম্য। সমাজে কেবল বৈষম্য (প্রকৃতপ্রস্তাবে সমাজের মুষ্ঠিমেয় সম্পদলোভী লোকের পক্ষে উদ্বৃত্তশ্রম আত্মসাৎ করে ধনী হয়ে উঠার সামজিক-অর্থনীতিক কাঠামো) সৃষ্টি হলেই তারা ধনকুবের হতে পারেন, অন্যথায় নয় এবং এই বৈষম্য ব্যতিরেকে তারা মানুষের শ্রমঘামরক্তের বিন্দু বিন্দু সঞ্চয়ে সৃষ্ট সিন্ধুতে অবগাহন করার আনন্দ থেকে একেবারেই বঞ্চিত হন এবং এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হতে পারাই তাদের যাপিতজীবনের একমাত্র আরাধ্য।
যাদুকাটা-ধোপাজান নদীতে প্রশাসনকে হাইকোর্টের আদেশ মেনে মানুষের উপর নয়, বাল্কহেড নৌকা, ড্রেজার, বোমা মেশিন ইত্যাদি যন্ত্রের উপরে কারফিউ আরোপ করতে হবে, নদীগুলোতে এই যন্ত্রের ব্যবহার প্রতিহতকরণ কেবল নির্বাহী আদশে নয় মাঠপর্যায়ে কার্যকর করতে হবে। এই জন্যে পুলিশ প্রশাসনকে বালু-পাথরখেকো চক্রের আধিপত্যের নিগড় ভেঙে বেরিয়ে অসতে হবে। কথাটা বলা যতো সোজা কার্যকর করা ততো সোজা নয়। সমাজে মানুষের চেতনায় সম্পদে ব্যক্তিমালিকনার প্রপঞ্চ থেকে উদ্ভূত মাৎসর্য (পরশ্রীকাতরতা) সমূলে নির্মূল না হলে তা একেবারেই অসম্ভব অর্থাৎ এমতাবস্থায় আদানি কিংবা বেনজিরের সম্পদ যতোই বাড়–ক তাঁদের ‘আরও চাই’-এর ‘খাই খাই’ মানসতার অবসান কখনওই হবে না।
যাদুকাটা-ধোপাজানে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানপ্রশ্নে প্রশাসন ও পুলিশ জনগণবান্ধব না হয়ে উঠলে অবস্থা যেমন ছিল তেমনই থেকে যাবে, বালুপাথর লুট হতেই থাকবে। বারকিশ্রমিকরা কোনও দিনই বালুপাথর উত্তোলনের পেশায় ফিরে এসে জীবননির্বাহের সুযোগ পাবে না। আর সমাজের যে-সব কেউকেটারা পিছনে থেকে বালুপাথর লুটের কারবার করেন ও কলকাঠি নাড়েন তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে না, তাদেরকে খোঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।