অর্থনীতিটা শিষ্ট হয়ে উঠলে সমাজটাও কাঠামোগত সহিংসতার বলয় থেকে বেরিয়ে এসে শিষ্ট হয়ে উঠবে সংবাদটির শিরোনাম ‘ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে মারধর, ভিডিও ভাইরাল’। সংবাদবিবরণীতে বলা হয়েছে, “কথা কাটাকাটির জেরে এক স্কুলছাত্রের বিরুদ্ধে সহপাঠীকে বেধড়ক মারধরের একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। গত রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জ শহরের এইচএমপি উচ্চ বিদ্যালয় এবং সুনামগঞ্জ কেন্দ্রীয় মডেল মসজিদের মাঝামাঝি এলাকায়।” এতে অবাক হওয়ার কোনও দরকার নেই। এমনটাই হচ্ছে এখন এবং পরে আরও হবে। আমরা আমাদের সমাজটাকে এভাবেই তৈরি করে ফেলেছি এখানে বড়রা কোনও নৈতিকতার ধার ধারেন না, সুতরাং ছোটরা তো এমন হবেই। ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ বাবা-মা কিংবা অভিভাবকেরা ভাত খাওয়ার মতো ঘুষ, সুদ ইত্যাদি খান। অতিরিক্ত মুনাফার টাকায়, ঠকিয়ে কিংবা অবৈধ ও অন্যায় পথে অর্জিত আয়ে জীবন নির্বাহ করেন এবং প্রতিনিয়ত পরশ্রীকাতরতায় ভোগেন। পরশ্রীকাতরতায় ভোগতে ভোগেতে সম্পদসঞ্চয়ের ইঁদুর দৌড়ে হন্তদন্ত হয়ে কখন মানুষ নামের অন্তরালে অমানুষ হয়ে উঠেন, নিজেই জানে না। আর ধনসঞ্চয়ের এই ইঁদুর দৌড়ের ব্যস্ততায় নিপতিত হয়ে সন্তানকে মানুষ করার জন্যে একটু ব্যস্ত হওয়ার অবকাশ থাকে না, বরং সন্তানের উপর প্রতিনিয়ত শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চলতে থাকে জানতে-অজানতে। আসলে শিশুদের জন্যে মানুষের বাচ্চা হিসেবে গড়ে উঠার কোনও অনুকূল সামাজিক-আর্থনীতিক পরিবেশ-পরিসর এই দেশে এখনও গড়ে উঠেনি। ছোটদের মানবসুলভ মন ও সুস্থ শরীর গঠনের জন্যে শিক্ষা ও শরীরচর্চার ক্ষেত্রটি, বিপরীতে ক্রমে সংকীর্ণ ও দূষিত করে তোলা হয়েছে ও হচ্ছে। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো দেশে প্রতিষ্ঠিত নষ্ট রাজনীতি উৎখাতের জন্যে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যদিও রাষ্ট্রসংস্কার না করে আর্থনীতিক সংস্কার জরুরি বলে অনেকে মনে করেন। অপরদিকে শিশুদের উপযুক্ত ইন্টারনেট ব্যবস্থা নেই, তারা যে-ইন্টারনেট ব্যবস্থাটি সহজে হাতের কাছে পাচ্ছে সেটা তাদেরকে মানবিক করে তোলতে পারছে না, বরং তাদের মানসিকতাকে বিকৃত করে তোলছে। এমতাবস্থায় সমাজবিকৃতির অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীলতার যে জায়গায় গিয়ে আমরা উপনীত হয়েছি, সেখান থেকে ফিরে এসে প্রগতির পথে পা রাখতে হলে অবশ্যই প্রথমে আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্কটিকে বদলে দিতে হবে, সোজা কথায় বদলাতে হবে অর্থনীতিটাকে। বিদ্যমান অর্থনীতিটাই আমাদের নৈতিকতার অধঃপতনকে নিশ্চিত করে একটি কাঠামোগত সহিংসতার সামাজিক পরিসরে আমাদেরকে বাস করতে বাধ্য করছে, মানবিকতার মধ্যে আমরা বাস করতে পারছি না, কার্যত বাস করছি দানবিকতার মধ্যে। যার জন্যে এক শিশুসতীর্থ অন্য শিশুসতীর্থের প্রতি সহমর্মিতা হারিয়ে সহিংস হয়ে উঠেছে, তারা তাদের চেতনায় পরস্পর বন্ধুতার শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হয়ে শত্রুতার সম্পর্ককে ধারণ করছে। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হতে পারে। সে অবকাশ এখানে নেই। কেবল বলি, নষ্ট হয়ে যাওয়া এই শিশুকে শিষ্ট করে তোলতে হলে সর্বাগ্রে দুষ্ট (অর্থাৎ শোষণভিত্তিক) অর্থনীতিটাকে বদলে দিয়ে শিষ্ট (শোষণমুক্ত) করে তোলতে হবে। অর্থনীতিটা শিষ্ট হয়ে উঠলে সমাজটাও কাঠামোগত সহিংসতার বলয় থেকে বেরিয়ে এসে শিষ্ট হয়ে উঠবে এবং শিক্ষাব্যবস্থাটাও আর মুখস্তনির্ভর (মুনাফালোভী গাইডনির্ভর) থাকবে না, সেটা সৃজনশীলতা অর্জন করে সত্যিকার অর্থেই শিষ্ট হয়ে উঠবে। নষ্ট শিশুর শিষ্ট হওয়ার নিয়ম এটাই।