পৃথিবীতে মানুষের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে জ্ঞান অর্জন দ্বারা। জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়ে উঠে ধারাবাহিক ও যুগোপযোগী জ্ঞানের চর্চা দ্বারা। জ্ঞান চর্চা করতে করতে মানুষ ধর্ম, সাহিত্য, জলবায়ু, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি বিষয়ে ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট ধারণা পেয়ে এগিয়ে গেছে। মানুষ যতোই জ্ঞান অর্জনের পথে এগিয়ে গেছে ততোই মানুষ বুঝতে পারছে অনেক অনেক বিষয় তার অজানা। সে তখন আরও জানতে চায় এবং জ্ঞান চর্চা করে। যে মানুষ আরও বেশি জানার চেষ্টা করছে না, সে মনে মনে তার অবস্থানে নিজেকে খুব জ্ঞানী ভাবে এমনকি সে কখনও কখনও তার মতের সাথে মিলে না - এমন কথা শুনলে - সে উগ্র হয়ে উঠে কথায় ও আচরণে। সভ্য জগতে বসবাস করলেও মূলত এখানেই ওই ধরনের মানুষের সভ্যতা মার খায়। সভ্য মানুষের অনেক অনেক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি হলো অন্য মানুষের মতামত শুনে তারা ক্ষেপে যায় না, বরং ; ধৈর্য্য ধরে অন্য মানুষের মতামত শুনে এবং জ্ঞান দিয়ে হয় মেনে নেয় নতুবা যৌক্তিক মতামত দিয়ে অন্য মানুষের মতামত খ-ন করে। এই গুণাবলিকে বলে পরমত সহিষ্ণুতা। যারা কোনো বিষয়ে অন্য মানুষের মতামত ধৈর্য্য ধরে শুনে তারা পরমত সহিষ্ণু বা পরমত সহনশীল। এখানেই একজন মানুষের সভ্যতার প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠে। পরমতে অসহিষ্ণু মানুষ অন্য মানুষের মতামত যদি তাদের পছন্দের মতের বিরুদ্ধে যায়, তখন সে অস্থির হয়ে উঠে এবং রাগ করে। অনেক সময় মনোমালিন্য হয় এবং অসহিষ্ণু লোকের দ্বারা বড়ো রকমের অঘটন ঘটে যায়।
আমাদের দেশে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে রাজনীতি। কিন্তু ; এখানেও প্রকৃত অর্থে রাজনীতি চর্চা কম। সেজন্যে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের মানুষের মাঝে অসহিষ্ণুতার চিত্র বেশি ফুটে। এখানে মানুষ এতো বেশি রাজনৈতিক হয়ে উঠে যে পার্কে কিংবা অফিস আদালতে বা বাজারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বলা যায় প্রায় সবখানেই রাজনীতির আলোচনা চলে সকাল দুপুর বিকাল রাত সবসময়। সমস্যা হলো, এখানে সকলেই রাজনীতি করে। এটা যে মহাঅপরাধ সে কথা বলা যাবে না। আবার খুব যে ভালো তা-ও বলা যায় না। সমস্যা হলো যারা রাজনীতি করে তাদের সবার ধারাবাহিক রাজনৈতিক জ্ঞান চর্চা নাই ও ইতিহাসে শ্রদ্ধা নাই। ইতিহাস জানলে-তো শ্রদ্ধা জন্ম নিবে।
জানতে হলে বই খুলে পড়তে হয়। রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু কয়েকটি সভায় গিয়ে নিজের দলের নেতার বক্তৃতা শুনে এবং শুধু পছন্দের একটা বা দুইটা পত্রিকা পড়ে আর দুই একজনের লেখা বই পড়ে আর টেলিভিশনে দলের পছন্দের নেতাদের বক্তব্য শুনেই জানা যায় না। প্রকৃত রাজনৈতিক ইতিহাস জানতে হলে ইতিহাসের খুঁজে অনেক অনেক বই ঘাটাঘাটি করতে হয়। নিজের দেশের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য না জেনে যারা রাজনীতি করে তাদের মাঝেই পরমত সহনশীলতার অভাব সবচেয়ে বেশি।
আমাদের অসহিষ্ণু মানুষের প্রধান সমস্যা হলো, কেউ কেউ নিজ নিজ কাজের দিকে মনোযোগ কম। এখানে রিকসা চালক, সিএনজি চালিত অটোরিকসা চালক, ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক চালক তাদের নিজেদের বাহনটির লাইসেন্স আছে কি-না, ভূষিমালের কর্মচারী ও মালিক তার নিজের দোকানের মালামাল মেয়াদোত্তীর্ণ কি-না, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের আজ কী পড়াবেন সে প্রস্তুতি আছে কি-বা নাই, নামে শিক্ষার্থী অথচ পাঠ্যবই সমূহ পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে গিয়ে আরও জ্ঞান চর্চার অভ্যাস আছে কি-বা নাই এসবের দিকে ততোটা মনোযোগী না যতোটা রাজনীতির দিকে মুখিয়ে থাকে, একইভাবে নানা পেশাজীবীরা টেবিলে বসে বই খুলে কিংবা ক¤িপউটারের সামনে বসে আগামীকালের জন্যে স্টাডি করেছেন কি-না সে খবর নাই, একজন লেখক বা সাহিত্যিক আরও লেখকের লেখা পড়া দরকার কি-না সেদিকে মনোযোগ নাই। এমনকি সবজি বিক্রেতা ও চা-স্টলের কাস্টমার সকলেই রাজনীতি করে। রাজনীতি ভালো, কিন্তু; যারা রাজনীতি করে এদের মধ্যে রাজনীতি সচেতন কতোজন!
রাজনীতির সাথে অর্থনীতি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে এবং সমাজ খুব নিবিড়ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে রয়। কাজেই অসহিষ্ণু মানুষের দ্বারা সমাজের স্বাভাবিক গতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এজন্যই সমাজের স্বাভাবিক স্থিতিশীল গতি ধরে রাখতে মানুষকে পরমত সহনশীলতার অভ্যাস করতে হয়। আর এটা তখনই সম্ভব হয়ে উঠে যখন মানুষ সচেতন ভাবে জ্ঞান চর্চা ও রাজনীতি চর্চা করে। এখানে সকলকেই সরাসরি রাজনীতি করতে হয় না। সমস্যাটা হলো, এখানে এদেশের প্রায় সকলেই রাজনৈতিক দলের নেতা হতে চায়। যে ছোট পদে আছে সে বড়ো পদ পেতে চায়। যার কোনো পদ নাই সে পদ পেতে মরিয়া হয়ে ছুটে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করতে শিক্ষা ও বয়স বিবেচনায় যার যেখানে যাওয়া মানায় না, সে সেখানে যেতে যায়। অনেকে নেতাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে সেরকম পদ পেয়েও যায়। তারপরেই এরকম অযোগ্য লোকের দ্বারাই ঘটতে থাকে একের পর এক অঘটন। পরমত সহনশীলতার অভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্যে ও আচরণে বেপরোয়া ভাব ফুটে উঠে। গণতন্ত্র মার খায়। ক্ষমতাসীন দলের মাঝে জনমত উপেক্ষার প্রবণতা প্রবলতর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সমাজ হয় অস্থির এবং এক সময় মানুষ হয়ে উঠে বিক্ষুব্ধ।
এমন অবস্থা অধিকাংশ অগণতান্ত্রিক শাসক দ্বারা পরিচালিত দেশে দেখা দেয়। এরই ফলস্বরূপ এদেশের এবং বিদেশের মাটিতে বিভিন্ন সময় ঘটে গণঅভ্যুত্থানের মতো ঘটনা। স্বাভাবিক স্থিতিশীল জীবন পেতে যখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় সাধারণ মানুষ তখন সাময়িকভাবে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভরসা হারায়। তখনই প্রয়োজন হয় এবং খুঁজে সমাজের শিক্ষিত মানুষ ও সুশীল সমাজের মানুষ। দেখা যায়, ২০২৪ খ্রীস্টিয় সালের ৫ আগস্টের ছাত্র জনতার বিপ্লবের পরে বাংলাদেশ পরিচালনায় দেশে বিদেশে নানান রকম ভালো কাজে অবদান রাখা মানুষের খোঁজ পড়ে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এখানে কোনো রাজনৈতিক দল নাই। তবে এই সরকারের প্রতি দেশের জনগণের কোনো ক্ষোভ নাই। বরং; মানুষ আশাবাদী, এই সরকারের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে আবারও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হবে, সরকার গঠিত হবে এবং বিরোধী দল থাকবে। তার আগে সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল সমূহেরও পরমত সহনশীলতার চর্চা করার মাধ্যমে আরও গণতান্ত্রিক হওয়ার চর্চা করতে হবে।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যারা রাজনীতি করবেন তাদেরকে একজন শিক্ষকের মতো, একজন আইনজীবীর মতো, একজন প্রকৌশলীর মতো, একজন কলামিস্টের মতো, একজন গবেষকের মতো নিয়মিত পড়াশোনা করা। জ্ঞান চর্চা করার প্রথম ধাপ হলো পড়াশোনা। রাজনীতিবিদের ঘর হয়ে উঠুক একেকটা ছোটোখাটো লাইব্রেরি যেখানে কবিতা, গল্প, গবেষণাগ্রন্থের পাশাপাশি ইতিহাসের বই থাকবে। রাজনীতিক নিজে যদি পড়াশোনা না-করে তাহলে তার কাছে কর্মী সমর্থকরা কি শিখবে!
প্রসঙ্গ যেখানে আমাদের দেশ এবং দেশের রাজনীতি, সেখানে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ও সামাজিক সাংস্কৃতিক ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সকল প্রকৃষ্ট গতিশীল মানুষের সমর্থন রাখা জরুরি। যে উদ্দেশ্যে শতশত ছাত্র জনতার প্রাণের বিনিময়ে এবং হাজার হাজার মানুষের নানান অঙ্গহানির বিনিময়ে যে ছাত্র জনতার বিপ্লব সফল হয়েছে তার প্রকৃত সুফল পেতে হলে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক দলের তাড়াহুড়ো করলে হবে না এবং দেশে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। সকলের ধৈর্যের এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের দেশে একটা প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ আসবে, যখন নির্বাচন এলে ভোট চুরি হবে না এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বললে কোনো অপশক্তি টুঁটি চেপে ধরবে না। হ্যাঁ, বিগত আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিলে এটা সম্ভব হবে।
আমাদের সমস্যা হলো, সরকারি দল কেবল সরকারেই থাকতে চায়। বিরোধী দল সরকারের ভালোটার প্রশংসা করে না, বরং; কেবল মন্দ খুঁজে সরকারকে ঝেটিয়ে নিজেরা সরকারে যেতে চায়। এখানে কেউ বিরোধী দলে থাকতে চায় না। আবার সরকারি দল বিরোধী দলের ভালোটাকে গ্রহণ করতে চায় না। এরা উভয়ই দিনে দিনে দলকানা হয়ে যায়। তারা কেউ তাদের নিজেদের দলের কোনো দোষ খুঁজে পায় না। তাহলে সরকার ও বিরোধী দলের ভালোটার প্রশংসা করবে কে অথবা ভুলটা ধরিয়ে দেবে কে? সেজন্যেই সকলকেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হয় না। কেউ কেউ থাকেন সরকারের ভালোটার প্রশংসা করেন ও ভুলটার সমালোচনা করেন এবং পাশাপাশি বিরোধী দলের যৌক্তিক আন্দোলনে সমর্থন দেন ও ভুল সময়ের উচ্ছৃখল আন্দোলনের সমালোচনা করেন। সমস্যা হলো, সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল এরা উভয়ই শুধু তাদের প্রশংসা পেতে চায়, কিন্তু; তাদের ভুলের সমালোচনা সয্য করতে পারে না। তখন যারা সমালোচক তাদেরকে রাজনৈতিক দলের রোষানলে পড়তে হয়। এমনটা হয় অসহিষ্ণু মনোভাবের কারণে। এমন অসহনশীলতার পরিবর্তন হতে পারে একমাত্র জ্ঞান চর্চা দ্বারা। জ্ঞান চর্চায় ধ্যান অগ্রগণ্য। নিজেকে যে-কোনো পরিস্থিতিতে স্থির রাখার জন্য বর্তমানে বিজ্ঞান সমর্থিত ব্যায়াম মেডিটেশন যা ধ্যানের কথা বলে, সেদিকে মনোযোগ দেয়া সকল জ্ঞানী মানুষের জন্য জাংরি। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নিয়মিত ইয়োগা এবং মেডিটেশন করা দরকার। আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, কৃষিবিদ, পুষ্টিবিদ, আইনবিদ, শিক্ষা-গবেষণা সকল ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে জ্ঞান চর্চা অব্যাহত থাকুক এবং আমরা পরমত সহনশীলতায় মনোযোগী হই।
[মোহাম্মদ আব্দুল হক : লেখক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক]