বঙ্গাব্দ নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে, কবে থেকে বাংলা সনের উৎপত্তি, কে এর প্রবর্তন করেন তা নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। নিবন্ধটির দুটো পর্ব, একে একে বিবৃত হচ্ছে।
প্রথম পর্ব:
গবেষক জয়নাল আবেদীন খান ‘বাংলা সন ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ’ নামক গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা ভাষায় এই বিষয়ে এর আগে কোন প্রামাণিক গ্রন্থ রচিত হয়নি। এই আলোচনার প্রথম পর্বে উৎস হিসেবে বঙ্গাব্দ বইটিকে মুখ্য সূত্র হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
কিংবদন্তির মহানায়ক মলহনের পুত্র বল্লাল রাজা (সপ্তদশ শতাব্দী)-এর বিভিন্ন কীর্তিগুলি বিজয় সেনের ( দ্বাদশ শতাব্দী) পুত্র বল্লাল এর নামে চালিয়ে দিতে স্বার্থান্বেষী মহল বহু বহু গ্রন্থ রচনা করেছে, ফলে নবাব বল্লাল এর প্রকৃত ইতিহাস, নকল ইতিহাসের নিচে চাপা পড়ে যায়। প্রচলিত জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক তথ্যাদি সমন্বয় করে লেখক রাজা বল্লাল এর আসল ইতিহাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে আলোচ্য গবেষণা গ্রন্থটি রচনা করেন।
নববর্ষ এলেই বাংলা সনের উদ্ভাবক কে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কারও মতে গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক (৫৯৩ – ৬৩৫ খ্রি), কারও মতে সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (১৪৯৩ -১৫১৯ খ্রি) কারও মতে মোগল স¤্রাট আকবর (১৫৫৬ – ১৬০৫ খ্রি.), আবার কারও মতে বল্লাল সেন বাংলা সনের উদ্ভাবক -গবেষক এ সংক্রান্ত প্রামাণ্য ঐতিহাসিক সূত্রগুলো দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন।
প্রাচীন হিন্দুসাহিত্যে ও লিপিমালায় বাংলা সনের উল্লেখ নাই, আকবরের প্রবর্তিত সৌরসনে বঙ্গাব্দের উল্লেখ নেই। হিন্দু আমলে বাংলা সন প্রচলিত ছিল না, শকাব্দ, বিক্রমাব্দ, লক্ষণাব্দ – বঙ্গাব্দ নয়।
আকবরের ইলাহী সন পারস্যের নওরোজ থেকে গণনা করা হয়, মাসের নামগুলোও পারস্য দেশীয়। বাংলা সন ও ইলাহী সন এক নয়, বাংলা সন ও ফসলী সন এক নয়, আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক নন – গবেষক লেখক বিভিন্ন সূত্র দ্বারা সেই তথ্য তুলে ধরেছেন।
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী যখন রাজা বল্লাল এর রাজত্বকাল তখন থেকে দলিলপত্রে বাংলাসনের উল্লেখ, গ্রামীণ জীবনে বাংলা সনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
বল্লাল ছিলেন মগ রাজা মঙ্গৎ রায়, যিনি ছিলেন আরাকানের নির্বাসিত রাজা। তিনি সদলবলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানী নামের আড়াল হন। তিনি মোঘলদের জায়গীরদার, মনসবদার ও করদ রাজা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল আবুল যা পরে বিকৃত হতে হতে বল্লাল হয়ে যায়।
তৎকালীন আরাকানে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর বাস ছিল, আরাকান ছিল দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার খাদ্যভা-ার। মাছে ভাতে আরাকানী – এই ছিল প্রবাদ। একসময় আরাকান বিশুদ্ধ ভারতীয় হিন্দুরাজ্য থাকলেও পরে একটি সঙ্কর ইন্দোচৈনিক রাজ্যে পরিণত হয়। আরাকান রাজারা সূর্যদেবতার বংশধর। আভারাজ মেঙ শোয়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে আরাকানরাজ নরমেখলা গৌড়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন, মুসলমান নাম ধারণ করেন ও মসজিদ নির্মাণ করেন।
মগ রাজসভায় সুফী ও হিন্দু আধ্যাত্মিক সাধনার সম্মেলন, সমন্বয়পন্থী ধর্মমত ও মিশ্রদেবতার উদ্ভব ঘটানো হয়। বল্লাল রাজার আমলে নারী দেবতার প্রাধান্য ছিল, তিনি বল্লালী হিন্দুয়ানি প্রতিষ্ঠা করেন যা বৌদ্ধ তান্ত্রিক ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বল্লাল রাজা বিভিন্ন ধর্মমতের সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন কিছু উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন করেছিলেন। তার আমলে মুসলমান জমিদারদের কালীপূজা করতে হত। বাংলা সন প্রতিষ্ঠা বল্লাল রাজা করেন যা তিনি স¤্রাট আকবর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করেন।
বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ যা ভারতীয় শকাব্দ ও বিক্রমাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। শকাব্দের প্রথম মাস চৈত্র, বিক্রমাব্দের দ্বিতীয় মাস কার্ত্তিক। বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ – যা শকাব্দের দ্বিতীয় ও বিক্রমাব্দের সপ্তম মাস। প্রকৃতপক্ষে অগ্রহায়ণ ছিল নববর্ষ শুরুর প্রথম মাস স্মরণাতীতকাল থেকেই। অগ্রহায়ণ বা বৎসরের অগ্রে যে যায়, অন্য অর্থ ধান উৎপাদনের মাস।
বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ হওয়ার কারণ এই অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ প্লাবিত, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ মাসে ঘটে। তিনি এ মাসে জন্মগ্রহণ করেন, বুদ্ধত্ব লাভ করেন, এই মাসেই মহানির্বাণ লাভ করেন।এটি তাদের কাছে পবিত্র মাস কাজেই বৈশাখ মাসকে বাংলা সনের প্রথম মাস করা হয়।
নববর্ষে তখন অনেক আয়োজন ছিল। চড়ক, হালখাতা, পুন্যাহ মেলা, বাসী খাবার ঠা-া করে খাওয়া – এই আচারগুলো হিন্দুদের ছিল না। চড়ক তিব্বতিদের একটি জনপ্রিয় উৎসব, ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গদেশে চড়ক পূজা ছিল না। হালখাতার রেওয়াজ চীন দেশে ছিল, গণেশ দেবতা ছিল বর্মী তৈলংদের প্রধান দেবতা, যা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান দেবতা নয়।
বল্লালী আমল ছিল বঙ্গ হিন্দুদের স্বর্ণযুগ। বল্লাল রাজা বঙ্গদেশে হিন্দু -মুসলমান-বৌদ্ধ ঐতিহ্যের চমৎকার সমন্বয় ঘটান। মূলত: আরাকান দেশীয় তাই তাঁর কার্যকলাপে বৌদ্ধ সংস্কৃতির বেশি ছিল।
বল্লাল রাজার বিভিন্ন কীর্তি ছিনতাই হয়েছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন গ্রন্থে তথ্য বিকৃতি করা হয়েছে। লেখক জয়নাল আবেদীন খান বিভিন্ন তথ্য ও জনশ্রুতির সন্নিবেশ ঘটিয়ে বল্লাল রাজার কীর্তিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই ছিল বঙ্গাব্দ বিষয়ে সূত্র অনুসন্ধান।
দ্বিতীয় পর্ব:
বর্ষ, নববর্ষ :
বর্ষ: বৃষ থাকে যাহাতে।
বৃ® = আবর্ত্তনবাহীর দিশাগ্রস্ত বিচ্ছুরণ।
বর্ষ হতে বর্ষকর, বর্ষাগিরি, বর্ষণ, বর্ষত্র, বর্ষবর, বর্ষধর, বর্ষপর্ব্বত, বর্ষপাত, বর্ষপর্ব্বত, বর্ষপাত, বর্ষপ্রবেশ, বর্ষশতী, বর্ষকর, বার্ষিক ইত্যাদি শব্দ।
বঙ্গীয় শব্দকোষ বর্ষ শব্দের প্রথম অর্থ দিয়েছেন, মেঘবারিপাত, যা প্রকৃতিতে সৃজন নিষেক করে। মেঘ হল জাগতিক বৃষ, আর রেত : হল বারি।
বৃষ বর্ষণ করে, বারি বর্ষণ করে যার ফলে প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয়, সবুজ সুফলা হয়। কাজেই যে সত্তা সৃজনশীলতা বর্ষণ করে তাকে বৃষ বলে, আর যা সে বর্ষণ করে (সৃজনশীল শক্তি) তাকে বলে বর্ষ।
বৃষ যে দেশে বর্ষণ করে, যে কালে বর্ষণ করে, যে পাত্রে বর্ষণ করে তার প্রত্যেকটিই বর্ষ। আদিম যৌথসমাজে মানুষে মানুষে বন্ধন ছিল দৃঢ়, সেই সমাজের পরিচালকরা বছরের শুরুতে বীজধান ও অন্যান্য বস্তু সমাজের সকল সদস্যকে বিধিমত ভাগ-বাঁটোয়ারা (বর্ষণ) করে দিতেন। সমাজের সদস্যরা সেগুলো নিয়ে সারাবছর চাষাবাদ করতেন, ফসল তুলে জমা করতেন, সেই ফসলের অংশ আবার পরিচালকের লোকজনদের কাছে তুলে দিতেন। এভাবেই বর্ষণের কাজটি চলত।
মেঘের বর্ষণটিও এরকম। সূর্য্যের তাপে পৃথিবীর জল জলীয়বা®প হয়ে আকাশে উবে যায়, আবার বৃষ্টিরূপে পৃথিবীতেই ফিরে আসে। সেই যৌথ সমাজের নিয়মের মত।
বছরের প্রথমেই বৃষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্ষণের কাজটি নতুন ভাবে শুরু করেন এজন্যই হয়ত নতুন বছরকে নববর্ষ বলা হয়। বাঙালি সংস্কৃতিতে হালখাতার আয়োজন, ফসল তোলা খাজনা দেওয়া ইত্যাদি কাজের হিসাব হয়তো নতুন বছরের শুরুতে আবার নতুন করে শুরু। তাই হয়তো নববর্ষ শব্দটির প্রচলন। দ্বিতীয় পর্বটি বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ অভিধানের আলোকে রচিত। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।