বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে গৃহীত ও স্বীকৃত পয়লা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ দিয়েছেন মো. মাহমুদুল হাসান নামে একজন আইনজীবী। সংস্কৃতি, ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনকে এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে- যেখানে বলা হয়েছে, হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে-অপরের ধর্মকে সম্মান করে এই পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পয়লা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পয়লা বৈশাখের কোনও স¤পর্ক নেই। (বাংলা ট্রিবিউন, ০৯ এপ্রিল ২০২৩)।
শুধু তা-ই নয়, নোটিশে ‘মঙ্গল’ শব্দটিকে ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে, যা নাকি বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক-এর সরাসরি লঙ্ঘন।
আইনত এসব উকিল নোটিশের কোনও গুরুত্ব বা তাৎপর্য নেই। অতীতেও নানা ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তাতে খুব বড় কোনও ঘটনা ঘটে গেছে বা বড় কোনও পরিবর্তন হয়ে গেছে তা নয়। বরং মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো একটি অনুষ্ঠান বন্ধের দাবি জানিয়ে যিনি নোটিশ পাঠিয়েছেন, তার নামটি দেশবাসী জানলো। চেহারায় না চিনলেও মানুষ অন্তত তার নামের সঙ্গে পরিচিত হলো। সোশাল মিডিয়ায় লোকজন যে তার ভর্ৎসনা করলো, তাতেও তার এক ধরনের নেগেটিভ ব্র্যান্ডিং হলো (তিনি হয়তো সেটিই চেয়েছেন)।
মনে রাখা দরকার, উকিল নোটিশ মানেই মামলা নয়। কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে সাধারণত কোনও আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে নোটিশ পাঠানো হলে সেটিকে লিগ্যাল নোটিশ বা উকিল নোটিশ বলা হয়। এটিকে মামলার পূর্ব প্রস্তুতিও বলা যায়। নোটিশে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় এবং অনুরোধ করা হয় এ সময়সীমার মধ্যে বিরোধের সমাধান করতে। না হলে কোন আইনে কীভাবে মামলা মোকদ্দমা করা হবে, সে বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তবে কিছু উকিল নোটিশ মামলা করার আগে দিতে হয়। যেমন, চেক ডিজঅনার-সংক্রান্ত মামলা করতে হলে আগে উকিল নোটিশ পাঠাতে হয়।
কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধের দাবি জানিয়ে যে নোটিশ পাঠানো হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এর জবাব না-ও দেন, তারপরও ওই আইনজীবী মামলা করে দেবেন – তা মনে হয় না। আবার এ বিষয়ে মামলা করলেই যে আদালত সেটি গ্রহণ করবেন, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কারণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা এরইমধ্যে ইউনেস্কোর ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’-এর তালিকাভুক্ত। তার মানে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সুতরাং কোনও একজন আইনজীবীর উকিল নোটিশে এটা বন্ধ হয়ে যাবে – এটি ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু তারপরও যে প্রশ্নটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না তা হলো, পয়লা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম প্রধান একটি অনুষঙ্গকে যে একজন আইনজীবী চ্যালেঞ্জ করলেন বা এটিকে যে তিনি বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ নয় বলে দাবি করলেন, এমনকি ‘মঙ্গল’ শব্দের মধ্যে তিনি যে ধর্মের গন্ধ পেলেন, সেটি কি একজন আইনজীবীর ব্যক্তিগত অবস্থান, নাকি আরও অসংখ্য মানুষ এই ধারণার সঙ্গে একমত?
প্রশ্ন হলো, ‘মঙ্গল’ যদি একটি বিশেষ ধর্মীয় (হিন্দুয়ানি) শব্দ হয়, তাহলে ‘মঙ্গলবার’কে তিনি কী বলবেন? এই বারের নাম বদলানোর জন্যও কি তিনি একটা উকিল নোটিশ পাঠাবেন?
বাংলা শব্দের ব্যবহার নিয়ে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি খুব অদ্ভুত। যেমন, আমরা লিখি পবিত্র রমজান মাস, পবিত্র কাবা শরিফ, পবিত্র জুমার দিন ইত্যাদি। কিন্তু কোনও মুসলমান সন্তানের নাম পবিত্র রাখি না। কারও নাম ‘পবিত্র’ মানেই তিনি মুসলিম নন। জল আর পানি নিয়েও জলঘোলা কম হয় না। মূলত এ কারণেই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হিন্দু সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেওয়া; ইসলামের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিকে মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং পক্ষান্তরে বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দু সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বছরের পর বছর ধরে চলছে।
বাস্তবতা হলো, ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করে মঙ্গল শোভাযাত্রা বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন না বা এটিকে সমর্থন করেন না, এমন লোকের সংখ্যা দেশে অনেক। এই মনে করার অধিকারও তাদের আছে। ফলে তাদের অনেকেই হয়তো মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশকেও মনে মনে সমর্থন করেন। কারণ বছরের পর বছর ধরে জনপরিসরে এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব মোটিফ, যেমন- পেঁচা, পাখি, ঘোড়া, মাছ ইত্যাদির প্রতিকৃতি প্রদর্শন করা হয়, সেগুলো মুসলিম ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সমস্যাটা এখানেই। সবকিছুর মধ্যে ধর্মকে টেনে আনার যে প্রবণতা একাত্তর-পূর্ববর্তী বাংলাদেশে ছিল, এখনও সেটি ক্রিয়াশীল।
বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দুয়ানি; জল মানেই হিন্দুর ভাষা; পেঁচা মানেই পূজার অনুষঙ্গ – এই যে ধারণাগুলো দেওয়া হয়েছে, তার পেছনেও রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতিও কম শক্তিশালী নয়। বিপরীতে পেঁচা বা অন্যান্য মোটিফ যে ধর্মীয় চিন্তা থেকে আসেনি, বরং এসব মোটিফ যে আবহমান বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির অনুষঙ্গ; এখানে যে অন্যের মঙ্গল কামনা এবং শিল্প ও নান্দনিকতাই মুখ্য – সেই বার্তাটিও বোধহয় আমজনতার মধ্যে খুব কার্যকরভাবে দেওয়া যায়নি।
ধর্ম মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সেটি অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু ইসলাম মানেই আরব নয়। আরব থেকে ইসলাম যখন এই ভূখ-ে এসেছে তখন সে এই ভূখ-ের মানুষের হাজার বছরের জীবনাচার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। তার চেয়ে বড় কথা, যে মানুষটি ফজরের আজানের শব্দে ঘুম থেকে জাগেন এবং মসজিদে যান, সেই মানুষটিই লক্ষ্মীপূজায় প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে নাড়– খান – এটাই বাঙালি সংস্কৃতির শক্তি। এখানে ধর্মের চেয়ে মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন অনেক বেশি শক্তিশালী।
সব ধর্মেরই মর্মবাণী শান্তি, পার¯পরিক সহমর্মিতা, ভালোবাসা। অথচ সারা বিশ্বে এই ধর্মের নামেই সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ ও দাঙ্গা হয়েছে। যখন যুদ্ধ ও দাঙ্গা হয় তখন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই খুন হয়। তাদের শরীর থেকে যে রক্ত বের হয়, তার রঙে কোনও পার্থক্য নেই। সুতরাং ধর্মকে মানুষের পারলৌকিক শান্তির জন্য ব্যক্তিগত পরিসরে রাখা গেলে মঙ্গল শোভাযাত্রার ‘মঙ্গল’ শব্দের ভেতরে ধর্মের গন্ধ খোঁজার প্রয়োজন হতো না। পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর প্রতিকৃতিতে পূজার মূর্তির সঙ্গে তুলনার করার প্রয়োজন হতো না।
শেষ করা যাক হাসান আজিজুল হকের একটি বক্তব্য দিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো একটি বিশাল ভূখ-ে হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ বসবাস করে এসেছে। কত বিচিত্রভাবে বেঁচেছে তারা, তারা কত অদ্ভুত পথে জীবিকা খুঁজেছে; জমিতে ফসল ফলিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, মন্দির মসজিদ তৈরি করেছে, উঠোনে ফুল ফুটিয়েছে, মাটির পাত্রে, কাঠের গায়ে, ধাতুকে নকশায় তুলেছে, গান গেয়েছে, কাব্য সাহিত্য সৃষ্টি করেছে। এসব বাদ দিয়ে কি মানুষ বাঁচতে পেরেছে? এসবের স্মৃতিতে ভরা যে ইতিহাস, এসবের নিদর্শনে পরিকীর্ণ যে মানবভূমি তা কি ফুঁৎকারে উড়ে যাবে? না, একটা অধ্যাদেশ জারি করলেই ধোঁয়া হয়ে শূন্যে মিলিয়ে যাবে?’ (হাসান আজিজুল হক, অপ্রকাশের ভার, ইউডিএল, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৭০)।
হাসান আজিজুল হক বলছেন, ‘সংস্কৃতি আর কিছুই নয়, মানুষের বাঁচার ইতিহাস, মানুষ বাঁচতে বাঁচতে বাঁচাকে সুন্দর করে তুলতে চায় আর তা করতে গিয়ে যা কিছু তৈরি করে টিকিয়ে রাখে- যেমন সংগীত, যেমন সাহিত্য, যেমন শিল্প, যেমন ঘটপট, বাড়িঘর, দালানকোঠা, মন্দির, মসজিদ – এসব কৃত্যই তো মানুষের সংস্কৃতি। বাঙালি সংস্কৃতিও তাই কোনও আজগুবি ব্যাপার নয়। কোনও ফতোয়ার মুখাপেক্ষীও নয়।’ [সংকলিত]
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।