গত মঙ্গলবার (১৬ মার্চ ২০২১) দৈনিক সুনামকণ্ঠের এক সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘গত ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে যাদুকাটা নদীর তীর কেটে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ছবি তোলতে গিয়ে সাংবাদিক কামাল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন।’ এই নির্যাতনের ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে মামুলি মনে হতই পারে, অহরহ এমন ঘটনা আমাদের সমাজ-পরিসরে ঘটেই চলেছে। এই সমাজে এমন এক ধরনের লোক আছেন যারা বর্তমানে ‘তরুণদের স্টাইল করে চুল কাটা’কে পছন্দ করেন না এবং তর্কে জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত জোর করে তরুণদের মাথার চুল চেছে ফেলে দিয়ে, যাকে বলে, মাথা ন্যাড়া করে দেন এবং মনের জ্বালা মিটিয়ে এক ধরনের স্বস্তি লাভ করেন, সঙ্গে আত্মতৃপ্তির ঢেকুরও তোলেন, বেশ একটা সমাজহিতকর কাজ করেছেন ভেবে। তাঁদের এমন সমাজহিতকর কাজের তালিকা অনেক লম্বা, আপাতত এখানে তা কহতব্য নয়। বোধ করি তাঁদের মানসতা এই যে, এইভাবে স্টাইল করে চুল কাটার কারণে ভালো সমাজটা খারাপ হয়ে যায় এবং প্রকারান্তরে নানাবিধ কর্মকাণ্ডের কার্যকারিতা সমাজকে প্রতিনিয়ত খারাপ করে ফেলে। অন্যদিকে দিনদুপুরে নদীর তীর কেটে বালু তোলছে যখন কতিপয় লোক, তখন একজন সাংবাদিক, সে-বালু তোলার ছবি তোলছেন এবং যারা বালু তোলছেন তাদের কাছে বালু তোলার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করা পছন্দ নয় বলে এই চিত্রী সাংবাদিককে বাজারের মধ্যে এক গাছের সঙ্গে কষে বেঁধে মারপিট করছেন এবং অবাক করার মতো বিষয় এই যে, তখন সমাজের লোকেরা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
একদিকে স্টাইল করে চুল কাটলে লোকেরা ক্ষেপে যাচ্ছেন, যেখানে ক্ষেপে উঠার তেমন কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না, অপরদিকে দিনে-দুপুরে নদীর তীর কেটে বালু উত্তোলন কিংবা একতলা থেকে দ্বিতলায় একটি বালিশ উত্তোলনের পারিশ্রমিক হাজার টাকার বেশি, পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির পরিসরে এইসব অনৈতিক ও অবৈধ কর্ম কিংবা বলা বাহুল্য ডাকাতি চলছে। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থপাচার, ঘুষগ্রহণ, জালিয়াতি, মাদকব্যবসায়, অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সম্পত্তি জবরদখল, অনিয়ম ও দুর্নীতি, ধর্ষণ ইত্যাদি এককথায় দিনদুপুরে ডাকাতিরই নামান্তর। কিন্তু স্টাইল করে চুল কাটলে রেগে যাওয়ার মতো এইসব দিনদুপুরে ডাকাতির মতো মাৎস্যন্যায় নিয়ে লোকেরা ক্ষেপে যাচ্ছেন না, বরং ধর্ষককে আনুকূল্য দেওয়ার জন্যে লোকের অভাব হচ্ছে না এবং সাংবাদিককে প্রকাশ্য দিবালোকে বর্বরোচিতভাবে অত্যাচার করলে লোকেরা শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের মতো তা প্রত্যক্ষ করে নয়নমন সার্থক করছেন। অন্যদিকে হাওররক্ষা বাঁধে দুর্নীতি করে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা। এবংপ্রকারের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড সমস্ত দেশজুড়ে, দেশের সমস্ত আর্থসামাজিক বিন্যাসের পরিসরে, প্রশাসনের স্তরে স্তরে, সামাজিক রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন ঘটতেই থাকে, তখন অনায়াসে বলাই যায়, সমাজটা পচেগলে একবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। পত্রিকান্তরে খবর পাঠ করা যায়, ব্যাংকগুলোর টাকা দুর্বৃত্তরা প্রতিকারহীনভাবে হজম করে নিচ্ছে, প্রতিনিয়ত। যেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ তোলা ছিল অপরিহার্য ও অনিবার্য, সেখানে চিত্রী সাংবাদিক প্রতিবাদী হতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং প্রকারান্তরে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই অন্যায়। এমতাবস্থায় কথা এই যে, সমাজ পরিসরে বিদ্যমান শোষণ-শাসনের এই নির্যাতনের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে দেশ-জাতিকে, বদলে দিতে হবে আর্থসামাজিক বিন্যাস। জনগণের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য প্রতিরোধী উন্নয়ন চাই আমাদের এবং বুঝতে হবে কোনটা খারাপ আর কোনটা উপকারি। ভুলে গেলে চলবে না যে, ধনবৈষম্য সকল সামাজিক নিগ্রহের উৎস।
এখন বুঝতে হবে স্টাইল করে চুল কাটলে কোনও আর্থনীতিক ক্ষতির সম্মুখিন হয় না দেশ, বরং হাওররক্ষা বাঁধের বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের সঙ্গে দেশের আর্থনীতিক ক্ষতির সমূহ আশঙ্কা বিদ্যমান, এমনকি ২০১৭ সালের মতো ফসলহানির ঘটনাকেও এই এমন দুর্নীতি ডেকে আনতে পারে। ক্ষেপলে এইরকম হাওর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষেপতে হবে, নির্বিরোধী স্টাইল করে চুল কাটার বিরুদ্ধে নয় বা এমনতর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নয়। এখন প্রয়োজনহীন অবান্তর জ্ঞান রপ্ত করার দিন শেষ হয়েছে, দেশের প্রতিটি মানুষকে সঞ্চয় করতে হবে মানবিক জ্ঞান, যা অর্জন না করলে মুক্তি অর্জন করা যায় না, বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধুর মতো শোষণবিরোধী মানুষকে হত্যা করে মুক্তির ডাক দিলে মানুষের মুক্তির সম্ভাবনা আসলে সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে, এমনকি সাধারণভাবে একটু গণতান্ত্রিক পরিবেশেও ফিরে যাওয়ার পথের প্রতিবন্ধকতা সরানো অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং অনিবার্যভাবে অবস্থা এমন হয়ে পড়ে যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় প্রকৃতপ্রস্তাবে কোনও এক গণবিরোধী কিংবা গণশত্রু, সুদখোরের চেয়ে এক কাঠি বাড়া আপদমস্তক শোষক। তাই বলি, মানবিক জ্ঞানের সঞ্চয় বৃদ্ধি করে সমাজের উন্নয়নকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে হবে এর কোনও বিকল্প নেই। গণতন্ত্র চর্চার আগে শত্রু মিত্রের ফারাক বুঝতে হবে।