বিশেষ প্রতিনিধি ::
উজান ভাটিতে ভারী বর্ষণে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জে ফের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দশদিন আগে জেলার প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছিলেন। ৭০২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এরমধ্যে ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠেছিলেন প্রায় ২৬ হাজার বন্যা কবলিত লোকজন। বাসাবাড়ি, জিনিষপত্র নষ্ট হওয়ার সঙ্গে রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এখন আবার ফের বন্যার আশঙ্কায় ক্ষয়-ক্ষতির সঙ্গে মানুষের ভোগান্তিও বাড়বে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। আগের বন্যার পানিতে নদ নদী ও হাওরে পানিভরা থাকায় এখন পানি বাড়লে দুর্ভোগ বাড়বে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এ নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষজনের।
এদিকে ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে জেলার নি¤œাঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক। সড়কে পানি ওঠায় জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তাহিরপুর উপজেলার। তলিয়ে গেছে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের উত্তর আরপিননগর, সাহেববাড়ী ঘাট, তেঘরিয়া, বড়পাড়া নদীর পাড়সহ বেশ কয়েকটি এলাকার রাস্তাঘাট। এ ছাড়া ছাতক, দোয়ারাবাজার, মধ্যনগরসহ বিভিন্ন উপজেলার নি¤œাঞ্চলের গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নি¤œাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষকে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাতে জানায়, মেঘালয়ে গত রবিবার থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত মেঘালয়ে ৩১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মেঘালয়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই সুনামগঞ্জে বন্যার শঙ্কা দেখা দেয়। এই পানি মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি থেকে সুনামগঞ্জ আসতে ৬-৮ ঘন্টা সময় লাগে। মূলত উজানের ভারী বর্ষণ পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি করে। আর এতেই বন্যাপরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সুনামগঞ্জে। একই সময়ে সুনামগঞ্জেও প্রায় ১৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জে রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত সুরমা নদীতে পানি বেড়েছে ৬৩ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপরে। একই সময় একই নদীতে ছাতক পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৫১ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপরে। এছাড়াও যাদুকাটা নদীতে রবিবার সন্ধ্যা থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত পানি বেড়েছে ১৭৪ সেন্টিমিটার। বর্তমানে যাদুকাটা নদীতে বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ১৭০, ছাতকে ৫০ এবং তাহিরপুরের লাউড়েরগড় পয়েন্টে হয়েছে ২৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। সুনামগঞ্জের এই তিনটি পয়েন্টের মধ্যে সুনামগঞ্জ ও লাউড়েরগড় পয়েন্টেই ভারী বর্ষণ হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পৌরশহরের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহিরুন নেসা বলেন, আমি ঈদের দিন থেকে পরিবার নিয়ে এক সপ্তাহ আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। চারদিন আগে এসেছি। এখন আবার পানি বাড়ছে। আগের বন্যাতেই আমার কাচা ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। জিনিষপত্র নষ্ট হয়েছে। এখন আবার পানি ঢুকলেই ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, নদী ও হাওর পানিতে ভরে আছে। এখন পানি বাড়লে মানুষের ক্ষতি হবে বেশি।
সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া এলাকার বাসিন্দা নাজমুল আলম বলেন, কিছুদিন আগে পানি আইলো, বন্যাও অইলো। এখন আবার রবিবার রাত থাকি পানি বাড়ের। পরিবার লইয়া এই পানির মাঝে বড় বিপদেই আছি, এখন পানি ঘরে ঢুকের। যদি না কমে, তাইলে সবাইরে নিয়া আশ্রয়কেন্দ্র যাওয়া লাগব।
পশ্চিম তেরিয়ার বাসিন্দা সাবিনা আক্তার বলেন, সপ্তাহ খানেকের বেশিদিন আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। পানি নামার পর বাড়িতে আসার পর ঘরের বেহাল অবস্থা কোনোভাবে রয়েছি। এখন নতুন করে পানি বাড়ায় আবারও ঘর দুয়ার ফেলে রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। কবে আমাদের দুর্ভোগ শেষ হবে জানি না।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের মইনপুর গ্রামের বাসিন্দা মনোয়ার হুসেন বলেন, আমার বাড়ি গাঙ্গের পাড়ে। গত বন্যায় ঘরে পানি উঠে অনেক ক্ষতি করেছে। কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। আবারও পানি আসছে। ঘরের কোনো খানি-খাদ্য নাই। কি করে পরিবার নিয়ে চলি।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান এরশাদ মিয়া জানান, রোববার থেকে ব্যাপক পরিমাণে উজানের ঢল নামছে। এ কারণে এলাকার অনেক রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। মানুষের বাড়িঘরেও পানি ঢুকেছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন জানান, তাহিরপুরের সীমান্ত নদী দিয়ে এবার প্রচুর পরিমাণে পাহাড়ি ঢল নামছে। এ কারণে পানি বাড়ছে। তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বম্ভরপুরের হাসান বশির জানান, রবিবার রাতের ঢলে অনেকের বাড়িঘর ও উঠানে পানি এসেছে। পানি বাড়ছে। আগের বন্যার পানিই এখনো পুরোপুরি নামেনি। এখন আবার পানি আসায় মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, মেঘালয়ের ভারী বর্ষণের সঙ্গে সুনামগঞ্জেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে নদ নদীর পানি বাড়ছে। তাই আগামী ৬ জুলাই পর্যন্ত বন্যা হতে পারে সুনামগঞ্জে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, নদ নদীর পানি বাড়ায় বন্যার আশঙ্কা আছে। তাই আমরা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি। পাশাপাশি বন্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন বন্যা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পুরো জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। প্লাবিত হয় জেলার ১ হাজার ১৮টি গ্রাম। আট লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। অসংখ্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। মানুষের বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে আশ্রয় নেয় ২৫ হাজার পরিবার। ২৩ জুনের পর থেকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে মানুষ বাড়িঘরে ফেরেন। আবার কেউ কেউ এখনো বাড়িতে ফিরতে পারেননি। মানুষের স্বস্তি ফেরার আগেই আবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।