1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৩:৪২ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বিস্ময় জাগানো সম্পদ ও তার মালিকরা : রাজেকুজ্জামান রতন

  • আপডেট সময় রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪

তথ্য এবং সত্যের আলোয় দেশবাসীর চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের সম্পদ তো দেখেছে, এবার দেখছে সরকারি কর্মচারীদের। এনবিআর কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য জানা গেছে। এর রেশ না মেলাতেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
ফয়সাল ও তার স্ত্রীর নামে থাকা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে ৫ কাঠার দুটি প্লট, শ্বশুরের নামে থাকা ঢাকার রমনা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট, খিলগাঁওয়ে শাশুড়ির নামে ১০ কাঠা প্লট জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া ফয়সাল ও তার আত্মীয়স্বজনের নামে থাকা ১৯টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ছাগলকা- দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। খামার মালিক সাতমসজিদ হাউজিং এলাকায় মাত্র পৌনে ৫ শতক জমি ভাড়া নিয়ে ২০ শতকের ওপর খামার গড়ে তুলেছিল। সেখানে তারা রামচন্দ্রপুর খালের প্রায় ১৫ শতক জায়গা দখলে নিয়েছিল। আর এখন জানা যাচ্ছে, বেড়িবাঁধ সড়কের পাশে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারটি গড়ে তোলা হয়েছিল সিটি করপোরেশনের জায়গায় অবৈধভাবে। এর আগে শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তার অবিশ্বাস্য স¤পদ, সেনাপ্রধানের ক্ষমতার অপব্যবহার দেখে মানুষের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। অনেকে বলেন, আমাদের স্মৃতিশক্তি নাকি খুবই কম। অনেকটা গোল্ড ফিশের মতো। অ্যাকুরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতেই ভুলে যায়।
আমাদের নতুন ইস্যু এলে পুরনো ইস্যু ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা প্রচ-। অবশ্য এ কারণেই কিছুটা সুস্থ আছি আমরা। তা না হলে রিজেন্ট সাহেবদের ‘কারবার’, স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ‘মিঠু চক্রের’ বিপুল দুর্নীতি, ক্যাসিনো স¤্রাট-খালেদের ক্ষমতা আর স¤পদ, নরসিংদীর পাপিয়াকা-, ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের হাজার কোটি টাকা পাচারের খবর, বালিশকা-, নানা ধরনের সরকারি ক্রয়কা-, নির্মাণকাজে লোহার রডের পরিবর্তে বাঁশকা-সহ নানা কা- দেখে মানুষ পাগল হয়ে যেত। এত ভয়াবহ অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয় দেখে দেশের জনগণ আজ যেন অসার হয়ে গেছে। বরং মনে হয়, তারা অপেক্ষায় আছে পরের খবরের জন্য। সত্যের চেয়ে বিস্ময়কর কিছু নেই। দুর্নীতি নিয়ে সত্য কথা বললে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রথমত অস্বীকার তারপর প্রতিবাদ এবং শেষে ষড়যন্ত্র খোঁজা হয়। কিন্তু দুর্নীতি হচ্ছে, এসব দেখেও যদি বিষয়টি অস্বীকার করা হতে থাকে তাহলে কি তাদের পক্ষে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে? কেননা দুর্নীতিকে অস্বীকার করার মানসিকতাই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য দায়ী। এ কথা সবাই মানেন যে, দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে আমরা চিহ্নিত হলে দেশের জন্য অগৌরবের আর কিছু হতে পারে না। ব্যক্তি হিসেবেও দুর্নীতিবাজ কোনো সম্মানসূচক সম্বোধন নয়। তারপরও দেশে দুর্নীতি চলছে এবং ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি করছে। এটা তো জানা কথা, দুর্নীতি করার ক্ষমতা না থাকলে দুর্নীতি করা যায় না। দুর্বলরা দুর্নীতি করতে পারে না।
দুর্নীতি দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা এবং সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দেয়। তাই শুভবুদ্ধির মানুষেরা হরহামেশা বলতে থাকেন, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দেশের বাইরে অর্থ পাচার ও চোরাচালান বন্ধ করতে হবে, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে, সংসদে বিতর্ক ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত-বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে, দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকে আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে, দুদককে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর করতে হবে, বিচার বিভাগের সততা ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে লাখ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে, কারণ এই টাকার মালিক দেশের জনগণ। জনপ্রশাসনে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি আমাদের সবার নজরে পড়ে, যেমন- নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, সর্বশেষ অস্ত্র বাণিজ্য বর্তমানে জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করেছে, ডলার ঘাটতি তৈরি হয়েছে আর প্রতিষ্ঠানগুলো স¤পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে অশ্রদ্ধা তৈরি করেছে।
একবার এক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে দুর্নীতি কমবে। সরকারি অফিসগুলোতে ৫ বছর আগে বেতন বাড়ানোর কারণে দুর্নীতি অনেক কমে গেছে।” কিন্তু সাধারণ মানুষ এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারে না। দুর্নীতিসংক্রান্ত পত্রিকার শিরোনামগুলো পড়লে বাংলাদেশে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা বোঝা যায়। দুর্নীতির কথা উঠলে সরকারের মন্ত্রীরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, “পৃথিবীর কোন দেশে দুর্নীতি নেই? দুর্নীতি বিএনপি-জাতীয় পার্টির আমলেও হয়েছে। আপনারা সেসব নিয়ে কথা বলেন না। কেবল আওয়ামী লীগ আমলে কিছু ঘটলেই শোরগোল তোলেন।” তখন আর কী করা! তবু মনে প্রশ্নটা থেকেই যায়, অতীতের দুর্নীতি কি বর্তমানের দুর্নীতিকে যুক্তিসঙ্গত করবে?
এবার সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্য (এমপি)। তাদের একজন বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে? চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সরকারি কর্মচারীদের হলফনামা আকারে স¤পদের হিসাব দাখিলের বিধান করার দাবি জানান। একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতিতে না জড়ান, সে জন্য আইন আরও কঠোর করতে পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যদিকে সরকার দলের আরেক সংসদ সদস্য অভিযোগ করেন, সরকারি কর্মকর্তারা দেশ-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। কিন্তু দোষ হয় রাজনীতিবিদদের।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে সংসদে বলা হয়, “সেখানে (উন্নয়ন ও কেনাকাটা) রাজনীতিবিদদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে জড়িত না থাকেন? ২০১৮ সালে জনপ্রশাসনে তথ্য এসেছিল, এক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছিল। এ রকম হাজার হাজার মতিউর (এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমান) আছেন।”
এখন সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। দুর্নীতি যেমন অনেকে মিলে করে তেমনি তারা পর¯পরকে রক্ষা করতেও চেষ্টা করে। এদের হাত যে কতদূর প্রসারিত হতে পারে তার একটা উদাহরণ মতিউর। যার বিচরণ ছিল অর্থমন্ত্রীর বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত এবং যার বদলি ঠেকাতে সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন পর্যন্ত সুপারিশ করেছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে তার হজের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, রিসোর্ট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকে রাখা টাকার হিসাব থেকে দেশে কোটিপতিদের সংখ্যা স¤পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু যারা অবৈধ টাকার মালিক তারা সব স¤পদ বৈধভাবে রাখবেন, এতটা সরল মানুষ কি? ফলে তাদের টাকা চলে যায় দেশের বাইরে, থাকে নগদরূপে। ব্যাংকের এই হিসাবের বাইরে কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির কথা অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন। আর এসব দেখে দেখে ইতিমধ্যে অভ্যস্ততাও গড়ে উঠেছে। কে, কীভাবে, কত দ্রুত হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি বনে গেলেন, এতে আর বিস্মিত হয় না। কেউ মনে করেন, ক্ষমতার খেলা, আবার অনেকেই এই হঠাৎ বিত্তবান হওয়াকে সৃষ্টিকর্তার অনুদান-কৃপাও বলে থাকেন। প্রভুর অসীম দয়ায় হঠাৎ বিত্তবানদের ভাগ্য বদলের ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবে তারা চরম অনৈতিক ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করেই যে হঠাৎ বিত্তশালী হয়েছেন, সেই সত্যটি জানলেও কেউ বলে না।
একটা প্রশ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় মানুষকে। ঘটনা ঘটার পরপরই অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে সব তথ্য প্রকাশিত হয়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি তো বটেই, তার আত্মীয়-স্বজনের নামে রাখা স¤পদের খবরও জানা যায়। এর সরল অর্থ কী? এত স¤পদ তো হঠাৎ করে অর্জিত হয়নি, কিন্তু হঠাৎ করে জানা গেল কীভাবে? অর্থাৎ এগুলো সবই জানা যায়, জানা ছিল। এদের সবারই তো ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ের মানুষের সঙ্গে সখ্যতা ছিল এবং আছে। মনে হয় যেন হঠাৎ অভিশাপ নেমে এলো এদের ওপর এবং ছিন্ন হলো ¯েœহের বন্ধন। ক্ষমতা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনার এই মেলবন্ধন শক্ত থাকা বা ছিন্ন হওয়ার কারণ নিহিত আছে রাজনীতিতে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিপরীতে জবাবদিহিতা এক প্রতিষেধকের কাজ করে। এই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে দুর্নীতির হাওরে মাঝে মাঝে দু-একটা বোয়াল ধরা পড়লেও, বোয়ালের বংশবিস্তার চলতেই থাকবে।
লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

 

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com