মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী ::
সুনামগঞ্জে সাম্প্রতিক বন্যায় ১২ উপজেলার অন্তত ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা মাছ ভেসেগছে। যার পরিমাণে ৪ হাজার মেট্রিকটন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। মাছের ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি প্রবল ¯্রােতে পুকুরের পার ধস, ভাঙনসহ অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি মিলে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামসুল করিম। এতে জেলার ক্ষুদ্র ও মাঝারি মৎস্যচাষীরা বিপাকে পড়েছেন। যাঁরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অথবা ধারদেনা নিয়ে মাছ চাষ করেছেন তাদের বেশিরভাগই সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছেন। ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে পুনরায় মাছ চাষে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ক্ষতিগ্রস্ত চাষীরা। তাই ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তারা।
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক মো. আশিস রহমান। বন্যায় তার মৎস্যখামারের কয়েকটি বড় পুকুর তলিয়ে যায়। এসব পুকুরে প্রায় কয়েক লাখ টাকার মাছ চাষ করেছিলেন তিনি। যখন মাছ বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই বন্যায় তলিয়ে যায়। এক রাতেই পানির তোড়ে ভেঙে যায় তাঁর পুকুরগুলোর পাড়। ভেসে যায় মাছ।
দোয়ারাবাজার উপজেলার এবারের বন্যায় অন্তত ১ হাজার ৬শ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এ কারণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছচাষিরা।
সাংবাদিক আশিস রহমান বলেন, হঠাৎই পানি বেড়ে যায়। এক রাতেই সব পুকুরে পানি ঢুকে পড়ে। বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে খামারের। কী করব, বুঝতে পারছি না।
একইভাবে দোয়ারাবাজার প্রেসক্লাব সভাপতি উপজেলার সদর ইউনিয়নের লামাসানিয়া গ্রামের বাসিন্দা সিনিয়র সাংবাদিক মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী ও তাঁর পরিবারের মৎস্যখামারের কয়েকটি পুকুর বানের ¯্রােতে ভেসে যায়। বন্যার প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনিসহ ওই গ্রামের বহু মাছচাষিরা। অনেকেরই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে। দেনা আছে মাছের খাবারের দোকানেও। সরকারি সহযোগিতা না পেলে এসব চাষি ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন না বলে মনে করছেন তাঁরা। এছাড়াও উপজেলার টেবলাই, পরমেশ্বরীপুর, মাইজখলা, বীরসিংহ, দলেরগাঁওসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের মৎস্যখামারীর মাছ বানের পানিতে ভেসেগেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১২টি উপজেলায় ২৫ হাজার ১৭৩টি পুকুর আছে। এর মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন ২০টি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ১৫৩টি, বাকি ২৫ হাজার পুকুরে ব্যক্তিমালিকানায় মাছ চাষ করা হয়। জেলাটিতে মাছচাষি আছেন ১৬ হাজার ৫০০ জন। এবারের বন্যায় প্রায় ৮ হাজার পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। ভেসে যাওয়া মাছ ও পোনার পরিমাণ ৪ হাজার মেট্রিক টন। এ ছাড়া মাছের খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষতি হয়েছে শত কোটি টাকার উপরে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের টিলাগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মাছচাষি ফারুক আহমদ বলেন, তাঁর মাছের খামারের তিনটি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এসব পুকুরে রুই, কাতলা, পাঙাশসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল। মাছগুলোর ওজন ছিল দুই থেকে আড়াই কেজি। মাত্র মাছ বিক্রি শুরু করেছিলেন তিনি। এর মধ্যেই দেখা দেয় বন্যা। ফারুক আহমদ বলেন, এখনো পানি আছে। কত ক্ষতি হলো বুঝতে পারছি না। পাহাড়ি ঢলে সর্বনাশ করে গেছে।
একই এলাকার নজরুল ইসলাম বলেন, তাঁরও দুটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। চলতি মাসেই মাছ বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই সর্বনাশ হয়ে গেছে।
এলাকাটির মনোয়ার হোসেন, আবু সালেক ও আরব আলীর মাছের খামারও ডুবে গেছে বন্যায়। আরব আলী বলেন, দুই দিনেই সব শেষ হয়ে গেছে। এখন তো পুকুরগুলোরও কোনো চিহ্ন নেই। সব পানির নিচে। শুরুতে মাছ রক্ষায় চেষ্টা করেছি। পরে দেখি এতে কোনো লাভ হবে না।
দোয়ারাবাজার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তুষার কান্তি বর্মণ বলেন, শুধু মাছচাষিরা নন, তাদের সঙ্গে মাছের খাবার সরবরাহকারীরাও বিপাকে পড়েছেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শামছুল করিম বলেন, বন্যায় সুনামগঞ্জের মাছ চাষীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। অন্যান্য সময়ের মতো ক্ষতিগ্রস্ত মাছ চাষীদের পুনর্বাসন করতে মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছি। কোনো সহযোগিতা, প্রণোদনা এলে মাছচাষিরা সেটা পাবেন।
উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জে ১৬ জুন থেকে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অসংখ্য বাড়িঘর, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। এখন পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। নদী ও হাওরে পানি কমেছে। তবে আবারো স্বল্পমেয়াদী বন্যার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।