‘ঋণের টাকার জন্য ধর্ষণ, বিষপানে গৃহবধূর মৃত্যু’ – এই শিরোনামে কথিত মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, আসলে সেটা আত্মহত্যা, চূড়ান্ত বিবেচনায় প্রকারান্তরে খুন। কী রকম ভয়ানক আত্মহত্যার বিবরণ গত শনিবারের (১ জুন ২০২৪) দৈনিক কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে মেলে। বলা হয়েছে, ‘অভাবের সংসারে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন এক দম্পতি। ২০ হাজার টাকা শোধ করেছেন। বাকি ২০ হাজার টাকার ঋণ শোধ করতে না পারায় প্রায় দুই মাস ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় গৃহবধূকে। বিচার চেয়েও না পেয়ে লজ্জায়, ক্ষোভে, অপমানে বিষ পান করেন ওই দম্পতি। এতে ওই গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। আর তাঁর স্বামী অসুস্থ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন।’
এমন ঘটনা বাংলাদেশ ভিন্ন পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে ঘটে কিনা জানি না। যদি ঘটে তা হলে বলাই যেতে পারে যে, সে দেশটির আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটা বাংলাদেশের মতো খতরনাক পুঁজিবাদী (নয়া ঔপনিবেশিক), অসভ্য ও খুনি তো বটেই। উন্নত দেশ অবশ্যই পুঁজিবাদী, কিন্তু সেখানে মানুষ মুক্তযৌনতার অধিকারী, ধর্ষণের মতো অসভ্যতা নেই। এখানের সমাজব্যবস্থার ভেতরে টাকা উসলের জন্য ধর্ষণ করার ঘটনাকে প্রতিরোধ করার মতো নয় বরং ধর্ষণ করে হলেও ঋণের টাকা উসল করার মতো অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেটা বোঝা যায় যখন সমাজপতি ও প্রশাসনের লোকেরা ধর্ষণের অভিযোগ থানায় যাতে করা না হয় তার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়াসহ প্রকারান্তরে ধর্ষণকারীকে রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠে। যেমন সংবাদে বলা হয়েছে, ‘ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দম্পতি সম্পর্কে খালাতো ভাই-বোন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের চাচাতো মামা আমেশ অভিযুক্তদের সঙ্গে মিলে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে মীমাংসার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এতে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার ও দুই পুলিশ সদস্য।’
ঋণদাতা ঋণ না পেয়ে আদালতের আশ্রয় নিতে পারতো, কিন্তু নেয় নি। সমাজ ও প্রশাসন তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় টাকা দিয়ে সবাইকে তাঁবেদার বানানো সম্ভব। এমন হতে পারতো যে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ঋণখেলাপি তৈরি না করে সেই টাকা দিয়ে সাধারণ গরিব মানুষকে কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতো। কিন্তু তা হয় নি, এমনটা হওয়ার আইন বা বিধান প্রতিষ্ঠিত আর্র্থসামাজিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের নিয়মে পড়ে না। ব্যাংকে টাকাওয়ালাকেই টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, টাকা যার নেই তার পক্ষে ব্যাংক থেকে টাকা পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। কার্যত এমনভাবেই এখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং ব্যবস্থাটিকে আমূল বদলে না দিল হবে না, সমাজ ব্যক্তিমালিকানার দাপটের চোটে অসম ও নিষ্ঠুর থেকেই যাবে। নিষ্ঠুরতার নমুনাটা বড়ই ভংঙ্কর। গরিব নারী ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারে না এবং ঋণদাতা ঋণের টাকা না পেয়ে নারীকে ধর্ষণ করে এবং সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করায়। একবার ধর্ষণে তার টাকা উসল হয় না, মাস দুয়েক ধরে ক্রমাগত ধর্ষণ করে চলে। বিদগ্ধজনের তাই স্বাভাবিক প্রশ্ন এই যে, প্রশাসন কার পাহারাদারি করে? যে-পুলিশ থানায় মামলা করার বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকে, তেমন পুলিশের বেতনে কি কেবল ধর্ষকের টাকার অংশ থাকে ধর্ষিতার টাকার অংশ থাকে না? না কি পারিতোষিকই শেষ কথা ? আসল কথা : ব্যক্তিমালিকনার ঝুলিতে কীছু জমা পড়লেই হলো, না পড়লে ধর্ষণেও আপত্তি নেই।