৩১ মে, ২০০৩। দুপুরের সময়। ঠাম্মা ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে। জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে। মা ঠাম্মার হাত ধরে এবং আমি মা’র কোলে। একটা সময় মা বুঝতে পারে এবার হাত ধরে থেকে লাভ নেই।
… শুধু এইটুকু না; যত কথাই ঠাম্মাকে নিয়ে আমার জানা সবই বাবা-মা কিংবা অন্য গুরুজনদের থেকে শোনা। আমার ঠাম্মা দিপালী চক্রবর্তী যখন মারা যান তখন আমার বয়স মাত্র ছয় মাস। আর তাই দুর্ভাগ্যবশত ঠাম্মাকে নিয়ে যা কিছুই লিখবো তা শুধুমাত্র জানা, অন্বেষণ এবং অনুভবের আদলেই।
সূচনাটা পরিবার থেকেই করতে চাই। আমাদের পরিবারের প্রত্যেকেরই সংগীতের প্রতি অনুরাগের উৎসস্থল ঠাম্মার অনুপ্রেরণা থেকেই। ঠাম্মা নিজেই গান করতেন বিশেষ করে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল গান। তাঁর অনুপ্রেরণায় পরিবারের সকলেই সংগীতচর্চায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করেন। আমার বাবা অধ্যাপক ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী’র কাছ থেকে শোনা- যে তাঁর শান্তিনিকেতনে পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ, অবদান ও অনুপ্রেরণা ছিল ষোলআনা। ঠাম্মার এই অনুপ্রেরণার শক্তিকে আধার করেই বাবার সংগীতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগ প্রতিষ্ঠা। এসব কিছুর মূলেই ছিল ঠাম্মার সবসময়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা।
মা প্রায়ই গল্প করে কীভাবে মায়ের বিয়ের পর ঠাম্মা মাকে নিজের মেয়ের মতো করে আপন করে নিয়েছিল। মা’র কথার মধ্যে সবসময়ই যে বিষয়টা অনুভবে আসতো তা হলো- ঠাম্মার মধ্যে পরিবার ও পরিবারের বাইরে দু’দিককার সামঞ্জস্য ধরে রাখার প্রবল শক্তি ছিল।
এই প্রসঙ্গ থেকে এবার আসা যাক ঠাম্মার পরিবারের বাইরে এক স্বতন্ত্র পরিচিত গড়ে তোলার ব্যাপারে। ৬২’র আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঠাম্মা ছাত্র ইউনিয়নের সাথে একজোট হয়ে কাজ করেন এবং কলেজে পড়াকালীন তিনি যোগদান করেন। এমনকি ঠাম্মার বাসাতেই ছাত্র ইউনিয়নের অনেক মিটিং হতো। এছাড়া ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে শহীদ দিবস এবং রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালনেও ঠাম্মা ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিলংয়ে রেডক্রসের পক্ষ থেকে শরণার্থীদের সেবা দানে ঠাম্মার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এই বিষয়ে সুনামগঞ্জে থাকা আমার ছোট ভাইয়ের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে বিশদভাবে জানতে পারি যে, “মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশের ভিতরে ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশি-বিদেশি মহিলা সংগঠন বিভিন্ন সভা আয়োজন করে বাংলাদেশে পাকিস্তানিবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে জনমত সংগঠন করে। মিসেস নূরজাহান মোর্শেদ বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি, লক্ষেèৗ সফর করে সেসব স্থানের পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানিবাহিনীর নৃশংস হামলার বিষয়ে অবহিত করেন। এছাড়া বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ (এমএনএ), মিসেস রাফিয়া আখতার ডলি (এমএনএ), রাজনৈতিক নেত্রী মিসেস মতিয়া চৌধুরী, মহিলা পরিষদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদিকা মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, মুশতারী শফী (চট্টগ্রাম), শিরিন বানু মিতিল (পাবনা), দিপালী চক্রবর্তী (সুনামগঞ্জ), রেখা সাহা (নেত্রকোণা) প্রমুখ নারী মুক্তিযুদ্ধের প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।”
পরবর্তীতে সুনামগঞ্জ মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তাঁর সেবামূলক কাজ অব্যাহত রাখেন। এসব কিছুর বাইরেও ঠাম্মার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কর্মকা-ের একটি হলো সুনামগঞ্জ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা। ঠাম্মা ছিলেন সেখানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ প্রসঙ্গে বলাই যায়, নারীর উন্নয়ন এবং অগ্রগতি নিয়ে ঠাম্মার চিন্তাভাবনা এবং কার্যকলাপের প্রতিফলন এই সুনামগঞ্জ মহিলা পরিষদ। তৎকালীন সমাজের নারী শিক্ষার বিষয়ে সংকীর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি যেমন নিজেকে সুশিক্ষিত করে তুলেছিলেন তেমনি অন্য নির্যাতিত, অসহায় সকল নারীদের শিক্ষা এবং অধিকার আদায়ের লড়াইয়েও তিনি পিছপা হননি।
এসব লেখার পরেও আমার অনুভূতি কী? হ্যাঁ, সেটাই এখানে উপযুক্ত প্রশ্ন। অনুভূতি এটাই যে নারী শুধু পরিবারে সীমাবদ্ধ থাকে না। পরিবার থেকে পেরিয়ে বাইরের জগতেও নারী দশভুজার মতো তার সমস্ত শক্তিকে উজাড় করে দিতে জানে। আর এইটুকু মর্মই যথেষ্ট ঠাম্মাকে নিয়ে আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে। আমার কাছে ঠাম্মা নিজের থেকেও পরিবারের এবং পরিবারের থেকেও সমাজের জন্য সর্বজনীন এক আদর্শ।