সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
রোববার আজারবাইজান সীমান্তবর্তী এলাকায় বাঁধ উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এ সময় তার সাথে নিহত হয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও।
তিন বছর আগে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইব্রাহিম রাইসি (৬৩)। ধারণা করা হত একদিন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির উত্তরসূরি হবেন তিনি। কিন্তু তার আগেই যেন বড় ধাক্কা খেল ইরান।
১৯৬০ সালে উত্তর-পূর্ব ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে ইব্রাহিম রাইসির জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন আলেম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বাবাকে হারান রাইসি। পরবর্তীতে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সেই কওম সেমিনারি অর্থাৎ ইরানের বৃহত্তম ইসলামী সেমিনারিতে যোগদান করেন রাইসি।
ছাত্র থাকাকালীনই তিনি পশ্চিমা-সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে এক ইসলামী বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হন শাহ।
মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তেহরানের পার্শ্ববর্তী শহর কারাজের প্রসিকিউটর-জেনারেল নিযুক্ত হন। এবং ২৫ বছর বয়সে তেহরানে ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৮৯ থাকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তেহরানের প্রসিকিউটর-জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন রাইসি। ২০০৪ সাল থেকে তিনি এক দশক জুডিসিয়াল অথোরিটির উপপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি।
নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোর বিরোধী হিসেবে প্রকাশ করা রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে শিয়া ইসলামি কট্টরপন্থার সমর্থক। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোরও কঠোর সমালোচক।
বিশ্বনবীর রক্তস¤পর্কিত উত্তরাধিকার দাবি জানিয়ে সবসময় কালো রঙের পাগড়ি পরিধান করতেন তিনি। আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থিরা, যারা ক্ষমতাসীন ইসলামী কট্টরপন্থি সরকারের বিরোধী। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তেহরানের রেভ্যুলুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়। সে সময় রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন তিনি। যদিও ইরান কখনও এই গণ-মৃত্যুদ-ের কথা স্বীকার করেনি। রাইসির ভূমিকা নিয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে সে বিষয়ে তিনি কখনও কিছু বলেননি।
রাজনৈতিক বন্দীদের মৃত্যুদ-ের ফলে রাইসি ইরানের বিরোধীদের মধ্যে বেশ অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ান ইব্রাহিম রাইসি। কিন্তু রাইসিকে হারিয়ে নির্বাচনে জয়ী হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট রাইসি পরবর্তীতে ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ সভার উপচেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নির্বাচনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এ সভা। তবে ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করে ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইব্রাহিম রাইসি।
কট্টরপন্থী হিসেবেই বেশি খ্যাতি পেয়েছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা আটকে যায় এবং ২০২২ সালের শেষের দিকে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর দেশটিতে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়।
রাইসির সময় ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিদর্শনে বাধা দিয়েছে এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে সমর্থন দিয়েছে। এ ছাড়া ইরান গাজার সংঘাতে ইসরায়েলের উপর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় এবং হিজবুল্লাহ ও হুথি আন্দোলনের মতো গোষ্ঠীগুলিকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে।
এছাড়া রাইসি সরকার, সামরিক এবং আইনসভার সমস্ত শাখার পাশাপাশি শক্তিশালী ধর্মতান্ত্রিক শাসক শ্রেণীর সাথে সুস¤পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তার সময়েই ইরানে নারীদের হিজাব পরিধান নিয়ে কড়াকড়ি আইন আরোপ করা হয়। যার জেরে প্রাণ হারিয়েছে একাধিক নারী।