1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০:৩৯ অপরাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

অর্ধেক যন্ত্রই বিকল, শতাধিক গায়েব

  • আপডেট সময় রবিবার, ১২ মে, ২০২৪

শামস শামীম ::
হাওরে কৃষকদের কম্বাইন হার্ভেস্টর বিতরণের নামে ভয়াবহ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে কৃষি বিভাগ ও সরবরাহকৃত কোম্পানির লোকজন। পার্টস নষ্ট হলে দুই বছরের মধ্যে নিজ খরচে মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও কোম্পানির লোকজন সেটা করছেনা। উচ্চমূল্যে পার্টস এনে মেরামত করছেন কৃষক। কম্বাইন হার্ভেস্টর বিতরণে অনিয়ম, টাকা নিয়েও যন্ত্র না দেওয়া, এক যন্ত্র একাধিকজনকে দিয়ে সরকার কর্তৃক ভর্তুকির বরাদ্দ তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। কৃষকের কাছ থেকে ৩০ ভাগ ও সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকির ৭০ ভাগ অর্থ নিয়েও অনেক যন্ত্র গায়েব করে ফেলা হয়েছে এমন অভিযোগও আছে।
সম্প্রতি হাওরে বোরো মওসুমে ধুম ধানকাটার সময় ভর্তুকির প্রায় তিন শতাধিক যন্ত্র বিকল ছিল। এছাড়াও আরো শতাধিক যন্ত্রের হদিস মিলছেনা। এ কারণে হাওরের ধানকাটা বিলম্বিত হচ্ছে। ১৯ এপ্রিল হাওরে কম্বাইন হার্ভেস্টর বিতরণে কৃষি বিভাগের দুর্নীতি, কোম্পানির দৌরাত্ম্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহিদকে অবগত করেছিলেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’ অধীনে কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছোট পরিসরে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০২৫ পর্যন্ত বৃহৎ আকারে মেয়াদ বাড়ানো হয়। বর্তমানে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। হাওর ও উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের ৭০ ভাগ ভর্তুকিমূল্যে ও সমতলে ৫০ ভাগ ভর্তুকিমূল্যে কম্বাইন হার্ভেস্টর বিতরণ করার কথা।
কৃষি বিভাগের মতে, সুনামগঞ্জ জেলায় অন্তত ৮৫০টি যন্ত্র কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি যন্ত্রে ১৫ লক্ষ ৭৫ হাজার থেকে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। বাস্তবে অর্ধেক যন্ত্রও মাঠে সচল নেই। তিন শতাধিক যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে আছে। মেরামত করে দিচ্ছেনা কোম্পানিগুলো। বর্তমানে অন্তত ১৪টি কোম্পানি এই যন্ত্র সরবরাহ করে। একটি কম্বাইন হার্ভেস্টর একদিনে ১০০ শ্রমিকের কাজ করতে পারে। একই সঙ্গে কর্তন, মাড়াই ও বস্তাজাত হওয়ায় কৃষকের সুবিধা হচ্ছে।
কৃষকরা জানান, সুনামগঞ্জে কম্বাইন হার্ভেস্টর যন্ত্র সরবরাহ করে এসিআই মটরস, আলীম ইন্ড্রাস্টিজ লি., এসকিউ ট্রেডিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লি., বাংলামার্ট করপোরেশন, উত্তরণ ইঞ্জিনিয়ারিং, আদি এন্টারপ্রাইজ, মেটাল, আবেদিন ইকো, পেমেন্টসহ বিভিন্ন কোম্পানি। যন্ত্র প্রদানের পর তারা নির্দিষ্ট এলাকায় অফিস করে টানা দুই বছর ওয়ারেন্টি দেওয়ার কথা। নি¤œমানের যন্ত্র সরবরাহ করায় হস্তান্তরের পরই বিকল হয়ে যায় এমন অভিযোগ কৃষকদের। কৃষক যন্ত্র কাজে লাগাতে পারছেনা। এই সুযোগে কৃষি বিভাগকে ম্যানেজ করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লোকজন যন্ত্র নিয়ে অন্যজনকে দিয়ে পুনরায় সরকারের ৭০ ভাগ ভর্তুকির টাকা উত্তোলন করে নেয়। যন্ত্র প্রদানে কৃষক নির্বাচনে অনিয়ম, কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণাসহ নানা বিষয়ে অসহায় কৃষকরা জেলা প্রশাসক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, সরবরাহকৃত যন্ত্রগুলোও নি¤œমানের হওয়ায় নষ্ট হওয়ার পর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটা করেনা। তাছাড়া যখন যন্ত্র হস্তান্তর করার কথা তখন না করে ওয়ারেন্টি মেয়াদ শেষ হবার কয়েকদিন আগেই হস্তান্তর করে যন্ত্র। যন্ত্র নষ্ট হলে জরুরি সময়ে বাধ্য হয়ে কৃষক উচ্চমূল্যে পার্টস কিনতে হয়। এভাবে কৃষি বিভাগ, মধ্যস্বত্বভোগী কৃষক ও কোম্পানির প্রতারণার জালে আটকা পড়ে নাভিশ্বাস জন্মেছে কৃষকদের।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খিরদরপুর গ্রামের কৃষক শাহজামাল ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে তালিকাভুক্ত হন। এ যন্ত্র ব্যবহার করছে আরেক মধ্যস্বত্বভোগী। বিষয়টি সামনে আসলে কৃষি বিভাগ ও কোম্পানির লোকজন নিজেদের বাঁচাতে একই উপজেলার বাগুয়া গ্রামের এহিয়া ও শান্তিপুর গ্রামের মোজাহিদ হোসেনের নামে যৌথভাবে যন্ত্রটির ব্যবহার বিষয়ে একটি এফিডেভিট করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে এই যন্ত্র দেওয়াই হয়নি, তালিকাভুক্ত কৃষকও ৩০ ভাগ টাকা দেয়নি। ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর একটি ভুয়া এফিডেভিট করে যৌথভাবে যন্ত্র ব্যবহার করছে বলে তারা স্বীকার করলেও বাস্তবে যন্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। শান্তিপুর গ্রামের মোজাহিদের বাবা মঈনুল ইসলাম একই অর্থ বছরে যন্ত্র উত্তোলন করেছেন মর্মে কৃষিবিভাগের তালিকায় ও বিতরণেও তার নাম আছে। বাস্তবে মধ্যস্বত্বভোগী এই কৃষককে যন্ত্র দিয়ে আবার নিয়ে গেছে এসকিউ কোম্পানি। একই উপজেলার বাগুয়া গ্রামের মামুনুর রশিদ বিভিন্ন কৃষকের নামে কৃষি বিভাগের সহায়তায় একাধিক যন্ত্র গ্রহণ করে। বাস্তবে তার কাছে যন্ত্র নেই।
শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের মনোহর রায়, আটগাঁওয়ের রুহুল আমিন যন্ত্র নষ্ট হওয়ার পর কোম্পানি ও কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেরামত করতে না পেরে বাধ্য হয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। কাশিপুর গ্রামের দীপক রঞ্জন দাস ও দীপু চন্দ্র দাসের নামে কাগজে-কলমে যন্ত্র উত্তোলন করলেও এগুলো কই আছে কেউ জানেনা। আনন্দপুরের মৃদুল চন্দ্র দাস ও আকাশ রায়ের যন্ত্র কেউ কোনদিন দেখেইনি। কাশিপুরের দীনার শাহরিয়ার ও আলা উদ্দিন আদনানের মেশিন অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও কৃষি বিভাগের লোকজন জড়িত বলে জানান কৃষকরা।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের কৃষক রফিক মিয়া ২১-২২ অর্থ বছরে তালিকাভুক্ত হন। তার নামে যন্ত্র বিতরণ দেখানো হয়, কিন্তু তিনি পাননি। এ ঘটনায় তিনি গত ১৯ ডিসেম্বর লিখিত অভিযোগ করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে। পরে কৃষি বিভাগের এই দুর্নীতির বিষয়ে ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলনও করেন। এ ঘটনায় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার মোস্তফা ইকবাল আজাদ তদন্ত করে এসকিউ কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট কৃষি কর্মকর্তা নয়ন মিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেদন দেন।
তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের পূর্বদই গ্রামের নিয়াব উদ্দিন যন্ত্র পাওয়ার পরই নষ্ট হয়ে গেছে। যে যন্ত্র দেবার কথা ছিল তা না দিয়ে নি¤œমানের যন্ত্র দেয়। তারপরও কোম্পানি ওয়ারেন্টি দেয়নি। উচ্চমূল্যে পার্টস কিনে তিনি কোনমতে চালু করেছেন। এ ঘটনায় ২০২৩ সালের ৩ মে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন তিনি।
বিশ্বম্ভরপুরের ফতেপুর ইউপির বসন্তপুর গ্রামের বুলবুল আহমের শ্যালক অলিউর রহমানসহ এসিআই কোম্পানিকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চার লক্ষ ৭ হাজার টাকা প্রদান করেন। এই মওসুমে যন্ত্র অনুমোদন না হওয়ায় যন্ত্রটি পুনরায় তারা নিয়ে যায়। এখন ধানকাটা চললেও তিনি যন্ত্র না পাওয়ায় ধান কাটতে পারছেন না।
শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক পিসি দাস বলেন, আমাদের এলাকায় কাগজেপত্রে ৫টি কম্বাইন হার্ভেস্টর আছে। কিন্তু বাস্তবে এগুলো মাঠে নেই। কৃষি অফিসার কোম্পানির সঙ্গে আতাত করে এগুলো বাইরের জেলায় বিক্রি করেছে। তিনি বলেন, শাল্লার ৪৯টি যন্ত্রের মধ্যে অর্ধেকই বিকল। বাকি অর্ধেকের মধ্যে অর্ধেক গায়েব হয়ে গেছে।
শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের কৃষক বাবলু রায় বলেন, ২০২৩ সালে কম্বাইন হার্ভেস্টর নিয়েছিলাম ভর্তুকিতে। আমাকে মেশিনটি দেবার পরই নষ্ট হয়ে গেছে। কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা মেরামত করে দেয়না।
শাল্লা উপজেলা কৃষক লীগের আহ্বায়ক রনজিত কুমার বিশ্বাস বলেন, শাল্লায় যতগুলো যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে সবগুলো পুরনো। কোম্পানি ও কৃষি বিভাগ আতাত করে পুরনো নষ্ট যন্ত্র গছিয়ে দিয়েছে কৃষকদের। তারা তুলে নিয়েছে সরকারের ভর্তুকির বিশাল টাকা। এবার মওসুমে ধান কাটতে বিলম্ব হয়েছে কৃষকদের।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক সালেহ আহমদ বলেন, এসিআই কোম্পানি আমাকে যন্ত্রটি দেওয়ার এক বছর পরই নিয়ে যায়। আমার কিস্তির টাকা টাকা দেয়নি। আমার যন্ত্রটি পরে অন্যত্র তারা বিক্রি করে দিয়েছে বলে শুনেছি।
শাল্লা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, পুরনো যন্ত্র বিতরণ করায় অধিকাংশই অকেজো হয়ে গেছে। আমরা কোম্পানিকে এগুলো সচল করে দেওয়ার জন্য বললেও তারা পাত্তা দিচ্ছেনা। তাই অনেক সময় যন্ত্র নিয়ে যায়, প্রযুক্তির সহায়তায় লক করে দেয়।
যন্ত্র সরবরাহে নিয়োজিত কম্পানি এসিআই মোটরসের ট্রেনিং অফিসার রনি হাসান বলেন, আমরা ইয়ানমার যন্ত্র সরবরাহ করি। পার্টসগুলো এভেলবল করার কাজ করছি। যন্ত্র নষ্ট হওয়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত করার চেষ্টা করি। তবে এবার ধানকাটার মওসুমে আমরা এলাকায় অবস্থান করে যন্ত্রের সমস্যা হলে সমাধান করেছি। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পার্টসের মূল্য বেশি। তাদের কোম্পানি কোনও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, যন্ত্র কাজ করছেনা বলে একাধিক কৃষক আমাদের অভিযোগ করেছেন। আমরা লিখিতভাবে কোম্পানিসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। বর্তমানে আমাদের ৭৪টি যন্ত্র বিকল আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস ১৯ এপ্রিল ধানকাটা উৎসবে দেখার হাওরে বলেন, যন্ত্র বিতরণে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা হলে প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে এই যন্ত্র হাওরের ধান উত্তোলনে কৃষকদের কষ্ট লাঘব করেছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহিদ ওইদিন সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমরা হার্ভেস্টর চায়না থেকে নিয়ে আসি। এই যন্ত্র একসাথে ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তায় ভরে কৃষকদের কাজ সহজ করে। সরকার প্রতিটি মেশিনে ৭০ ভাগ ভর্তুকি দেয়। মেশিন চালাতে গিয়ে যন্ত্রপাতির সমস্যা হলে কৃষি বিভাগ অথবা সংশ্লিষ্টরা ব্যবস্থা না নিলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। যন্ত্র নিয়ে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতি হলে ছাড় দেওয়া হবেনা।

 

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com