1. [email protected] : admin2017 :
  2. [email protected] : Sunam Kantha : Sunam Kantha
  3. [email protected] : wp-needuser : wp-needuser
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:৫৯ পূর্বাহ্ন
ঘোষণা ::
সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় সর্বাধিক পঠিত পত্রিকা সুনামকন্ঠে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের পাশে থাকার জন্য সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে যোগাযোগ করুন - 01711-368602

বাংলাদেশের নির্বাচন ফল, হাসিনার কর্তব্য : অমল সরকার

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচন কভার করতে গিয়েছিলাম। সেই সূত্রে সে দেশের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল। তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, কূটনীতিক, নানা বয়সের সাংবাদিকেরা যেমন ছিলেন, তেমনই কথা বলেছি, রিকসা চালক, অটো চালক, ফল-সবজি-মাছ বিক্রেতা, মুদি দোকানি, হোটেল কর্মচারীর মতো প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে।
ঢাকা থেকে পাঠানো একটি লেখায়, রিকসাচালক নুরুউদ্দীনের কথা বলেছিলাম। অন্য অনেকের এবং নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলতে পারি, ঢাকার রিকসা চালকদের টেলিভিশন চ্যানেলে রাজনীতির প্রাইম টাইম আলোচনায় নির্ভাবনায় আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। তেজগাঁওয়ের ফার্ম গেটের স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি নুরউদ্দীন ভোটের তিনদিন আগেই যেমন বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ পাস কইরা গ্যাসে।’ আরও বলেছিলেন, ‘বিএনপি ভোটে নাই তো কী হইসে! এবার লড়াই আমেরিকার লগে। ভোটের পরও তা চলব।’
সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা ও তাদের মিত্র দেশগুলির প্রতিক্রিয়ায় সেই রিকসাচালকের ভবিষ্যৎবাণী ¯পষ্ট। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মামুদ, শেখ হাসিনার বিশেষ আস্থাভাজন। আগের মন্ত্রিসভায় দক্ষতার সঙ্গে তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন। তার আগে বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কোনও সন্দেহ নেই, শুরুতেই তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি দুনিয়ার আস্থা অর্জন করতে হবে। কারণ, আমেরিকা বাংলাদেশের একটি বড় বাজার। বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পের। নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে মার্কিন প্রশাসন বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে সেন্টমার্টিন দ্বীপের দখল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনের একচেটিয়া বরাত পাওয়াতে তারা চাপ অব্যাহত রাখবে। সেই চাপ থেকে দেশকে রক্ষা করা হাছানের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
চীন ও ভারত, দুই বিবদমান দেশ এবার হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভূ-রাজনীতির মানদ-ে এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখা শেখ হাসিনার কূটনীতির অন্যতম সাফল্য। অথচ ভিন্ন সুরে আগের বিদেশমন্ত্রী আবদুল মোমেন ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছেন, “চীন আমাদের উন্নয়নে টাকা দিতে হাত বাড়িয়ে আছে। ভারতের অত টাকা নাই।” কথাটির সত্যাসত্য নিয়ে বিতর্কে না ঢুকেও বলা যায়, এই জাতীয় মন্তব্য নয়াদিল্লির কর্তাদের ভাল লাগার কথা নয়।
কে না জানে এই নির্বাচনে আমেরিকা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসী আক্রমণে শেষ পর্যন্ত রাশ টানতে বাধ্য হয় নয়াদিল্লির চাপেই। এও সত্য, ভারতের এই ইতিবাচক অবস্থান নিঃস্বার্থে নয়। ভারত চায়, এক. বাংলাদেশ যাতে আর একটা শ্রীলঙ্কা বা মলদ্বীপ না হয়ে যায়। দুই. বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি যেন শেখ হাসিনাকে ভবিষ্যতেও কাবু করতে না পারে। দুটিই ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশের নতুন সরকারের সামনে সম্ভাব্য চালেঞ্জগুলির মধ্যে সঙ্গত কারণেই আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতির বিষয়টি সামনে এসেছে। পদ্মা সেতুর জন্য শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ এক অটো চালক বলেছিলেন, “মন চায়, কিন্তু পকেট সায় দেয় না।” আওয়ামী লীগের কট্টর এই সমর্থকের ভোট দেওয়ার ইচ্ছা ছিল প্রবল। কিন্তু যাতায়াতের খরচের কথা ভেবে বরিশালের বাড়িতে যাননি।
আমার পর্যবেক্ষণ বলে, অতীতের ভোটে অনিয়ম, মানবাধিকার হরণ, পুলিশি নিপীড়নের অভিযোগ ইত্যাদির তুলনায় সাধারণ মানুষের আসল সমস্যা ছিল জিনিসপত্রে দাম। হোটেলের এক কর্মচারী বলেছিলেন, “আট টাকার আলু আশি টাকায় কিনতে হইলে ভোটের কথা আর মাথায় থাকে না। মনে আনন্দ নাই, ভোটের মজাও উধাও।”
আমার উপলব্ধি বলে, যে মানুষেরা ভোট দেননি তাদের মধ্যে ওই হোটেল কর্মীর মতো আওয়ামী লীগেরও বহু সমর্থকেরা আছেন, যারা কর্মস্থল ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যাননি খরচখরচার কথা ভেবে। বাংলাদেশে এই পরিযায়ী বা মাইগ্রেন্টস লেবাররা সংখ্যায় বিপুল।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ অগ্রাধিকারের এক নম্বরে দ্রব্যের দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের আগেই মেনে নিয়েছিল, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা তাদের শাসনের অন্যতম ব্যর্থতা। এই ব্যাপারে মোড় ঘোরাতে হলে আগের বাণিজ্যমন্ত্রীকে বিদায় দিয়েই লক্ষ্যপূরণ হবে না, দল ও সরকারের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কঠোর অবস্থান জরুরি। মন্ত্রীর মুখ থেকে ‘মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙা অসম্ভব’ জাতীয় বিলাপ আর শুনতে চাইবে না মানুষ।
বিদেশিদের সামলানো, অর্থনীতির হাল ফেরানোর বিষয়ে আলোচনার বিরাম নেই। আমি মনে করি, এই নির্বাচনের পর বাংলাদেশ সরকার এবং শাসক দল আওয়ামী লীগকে আরও একটি বড় ধরনের সমস্যার মোকাবিলা নিয়ে এখন থেকেই ভাবনাচিন্তা শুরু করতে হবে। এই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপি অংশ নেয়নি। অংশ নিলে ভোটের ফল কী হত, বলা মুশকিল। তবে চোখকান বুজে বলা যায়, স্বতন্ত্র বা নির্দল হিসাবে বিজয়ী ৬২জন ছাড়াও জাতীয় পার্টি আরও যে সব বিরোধী নামধারী ও ওয়ার্কাস পার্টির মতো আওয়ামী লীগের সহযোগী দলের নেতারা জিতেছেন, লড়াইয়ে থাকলে তাঁদের আসনগুলি এবার বিএনপির ঝুলিতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। ফলে যে কড়াকড়ি, নজরদারির মধ্যে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে, খালেদা জিয়ার পার্টি তাতে অন্তত স্বচ্ছন্দে শক্তিশালী বিরোধী দল হতে পারত।
সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন রাজনৈতিক সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। সংসদ সেই লড়াইয়ের সর্বোচ্চ মঞ্চ। এই সূত্রে বিএনপি জনতার আদালত থেকে তাদের অভিযোগগুলির মান্যতা আদায় করে নিতে পারত। পশ্চিমবঙ্গের তিনবারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে একা জিতেছিলেন। তারপরও সংসদে বাংলার ৩৫জন বাম সাংসদ এই নারীকে নিয়ে তটস্থ থাকতেন। এবারের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি ঐতিহাসিক ভুল করল কী না তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।
কিন্তু আশু সমস্যাটি ভিন্ন। ভোটের দিন পুরানো ঢাকায় বিএনপি’র এক মাঝবয়সি নেতাকে বিলাপ করতে শুনেছি, ‘ভোটের বাস ছাইড়া দেওয়া মস্ত বড় ভুল। ভোট ঠেকানো গেল না। শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী। আর আমাগো সবই মাইনাস।’
আমি যদিও ওই বিএনপি নেতার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। বিএনপি ভোটে অংশ না নেওয়ার পাশাপাশি ভোট বয়কটেরও ডাক দিয়েছিল। ভোট পড়েছে ৪২ শতাংশের মতো। অর্থাৎ বুথে না যাওয়া ভোটারের সংখ্যা বেশি। এই পরিসংখ্যান যেমন বিস্ময়কর নয়, তেমনই তা তুলে ধরে ভোটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। বাংলাদেশকে আমি যতদূর বুঝেছি, সে দেশের রাজনীতি সম্পূর্ণ তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একটি পক্ষ আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী শক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধজাত চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িকতা-সহ শেখ মুজিবুরের নীতি-আদর্শের প্রতি আস্থাশীল।
বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন আর এক পক্ষ যাঁরা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরোধী। এই শিবিরের মানুষ শুধু দলের কথায় ভোট বয়কট করবে তাই-ই নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে পদে পদে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার চেষ্টা চালাবে। জেনারেল জিয়াউর রহমান, হুসেইন মহম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার জমানা যোগ করলে এই শক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২৯ বছর ক্ষমতা ভোগ করেছে। ফলে এখন সরকারে না থাকলেও সমাজ ও প্রশাসনে তাদের অনুগত, সুবিধাভোগী মানুষেরা বহাল তবিয়তে আছেন। পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে আওয়ামী লীগের বহু নেতা-মন্ত্রী বিপুল ধন-স¤পত্তির মালিক। কিন্তু বিএনপি’র অবস্থা তাই বলে ভারতের কংগ্রেসের মতো নয়, দল চালাতে যাদের কার্যত ভিক্ষার ঝুলি হাতে বেরুতে হয়েছে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার পার্টিকে অর্থ জোগানোর মানুষ কম নেই।
কিন্তু বিএনপি’র প্রধান সমস্যা হল নেতৃত্ব। খালেদা জিয়া শয্যাশায়ী। তারেক জিয়া লন্ডনে বসে অনলাইনে দল চালান। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মঈন খানের মতো সজ্জন রাজনীতিকদের হাতে তিনি নেতৃত্ব ছাড়তে নারাজ। সুদূর লন্ডনে বসে তারেক দলে পরিবারতন্ত্র বজায় রাখতে মরিয়া। তিনি চান না, তার অনুপস্থিতিতে অন্য কোনও নেতা দলের মুখ হয়ে উঠুন। বিএনপি’র নেতৃত্বের এটাই সবচেয়ে বড় ঘাটতি। অনলাইনে কর্পোরেট কো¤পানি চালানো যায়, তৃতীয় দুনিয়ার কোনও দেশে রাজনৈতিক দল চালানো কঠিন। এখানে জনতার ‘ফেস টু ফেস’ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। তারেক জিয়া তো মুজিবুর রহমান নন, যাকে জেলবন্দি করা হলেও দেশবাসী তাঁরই নির্দেশিত পথে স্বাধীনতার লড়াই চালিয়ে গিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে ফের ভোট বয়কট এবং নেতৃত্বের অভাবে হতাশাগ্রস্ত বিএনপি’র সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের ইসলাম রক্ষার স্লোগান সামনে রেখে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির খপ্পরে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়। জামাত-ই-ইসলামির রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হলেও তাদের সামাজিক প্রভাব উবে যাওয়ার নয়। জামাতের পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলির বিএনপির দিশেহারা কর্মী-সমর্থকদের মাথায় ছাতা ধরতে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
নেতৃত্ব এবং আন্দোলন সংগ্রামের অভাবে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি-সহ বামদলগুলি। বাংলাদেশের এবারের নির্বাচন থেকে একটি বিষয় ¯পষ্ট, বিএনপি বিরোধী এই সব দলের অস্তিত্ব সংকট আওয়ামী লীগের জন্যও সমস্যা ডেকে এনেছে। গোটা দেশবাসী আওয়ামী এবং অ-আওয়ামী শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছেন। এই অবস্থার জন্য ছোট দলগুলি সমানভাবে দায়ী যাদের শাসকদলের প্রতীকে এবং দয়ায় ভোটের লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল।
যদিও বিগত দিনগুলিতে বিরোধী পরিসরে এই দলগুলি আরও বেশি সক্রিয় সরকারবিরোধী অবস্থান নিলে আওয়ামী লীগের জন্যই তা স্বস্তিদায়ক হতে পারত। বিরোধী পরিসর শুধু বিএনপির দখলে চলে যেত না। খালেদা জিয়ার দল যখন নেতৃত্বের অভাবে দিশেহারা তখন বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতির পরিসরেও মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবুরের রাজনীতি এবং অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শক্তিকে বিকশিত করার পথ প্রশস্ত করাটা শাসক দল আওয়ামী লিগের কাছে বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হওয়া উচিত। শাসক দলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতেও তা জরুরি।
লেখক: ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক; এক্সিকিউটিভ এডিটর, দ্য ওয়াল, কলকাতা; বাংলাদেশ বিষয়ক পর্যবেক্ষক।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

© All rights reserved © 2016-2021
Theme Developed By ThemesBazar.Com